Search This Blog

Friday, January 5, 2018

উত্তরণ

ওর একটাই সমস্যা। শব্দ গুলো কেবল পালিয়ে যাচ্ছে। আকাশ যেমন, আ গিয়ে লুকোচ্ছে টেবিলের নিচে, ক আর আ-কার নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়েছে, কি নিয়ে কে জানে! শ গম্ভীর মুখে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।  যেন ভাবছে, কি করবে, লাফ মারবে, নাকি ডানা মেলে উড়ে যাবে!
কিন্তু জানলা কোথায় এখানে? আর টেবিলই বা কোথায়! সামনের উঁচু পাথরটার দিকে তাকিয়ে আছে ও।  একটাই পাথর, প্রায় দোতলা বাড়ি সমান উঁচু। ওটায় উঠতে হবে. ওর গায়ে ছোট ছোট খাঁজ আছে, কোথাও বা আছে সামান্য একটু বাইরে বেরিয়ে থাকা পাথর।  সেখানে পা রেখে, কখনো সেগুলোকে আঁকড়ে ধরে উঠে যাও!
আর একদম উঠে যাওয়ার পর ?
গম্ভীর মুখের শ জানলা থেকে ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো, ঠোঁটের কোনে বিচ্ছু হাসি।
শব্দগুলো ওইরকমই।  কখন যে আসে কখন যে যায়! তখনি আসে যখন রক্তপাত হয়! চোখের জলের দামে আসে,  নিশ্বাস নিতে না পারার দামে আসে।
কোমরের কাছে দড়ির গিঁটটা টের পেলো ও।  পাথরটার খুব কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।
প্রথম ধাপটা কষ্টসাধ্য; ওর পক্ষে তো বটেই।
ছোটবেলায় সিঁড়িভাঙার অংক কক্ষনো মেলাতে পারেনি।  ওর গাছ থেকে আমপাড়ার গল্প 'পথের পাঁচালি' থেকে চুরি করা। পাঁচিল টপকানো দূরে থাকে, চৌকাঠ টপকে যে নিশ্চিন্দিপুর, সেখানে যাওয়াও ওর মানা ছিল। তাই প্রথম ধাপটাই এভারেস্ট। ওপরে আকাশের দিকে তাকালো ও, বুকের মধ্যে ভয়ের চোরাগোপ্তা আনাগোনা।
আকাশে বাংলা বর্ণমালা মেঘের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে, বলছে,  , ছুঁয়ে নাও আমাদের----দড়িটা টানটান।  এবার শুধু উঠে যাওয়া বাকি।
প্রথম চেষ্টা। তিরিশ সেকেন্ডও লাগলো না মাটিতে ফিরে আসতে। শব্দের থেকে বেশি তবে জীবন ? এমনটা ভাবেনি ও! শ টাও কেমন একটা হতাশ মুখে তাকালো ওর দিকে। তারপর লাফ দিলো ঘরবিহীন জানলাটা থেকে! হারিয়ে গেলো তারপর।
ভয়ের দামে শব্দ কেনার সাধ্য নেই তবে ওর ?  কিছুক্ষন উপর দিকে তাকিয়ে রইলো ও।  নীল আকাশের বদলে এক বিরাট শূন্য সেখানে। আর সেই শূন্যে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা বর্ণমালা।
আর ফিরবে না? উঁচু পাথরটার উপর থেকে একটা চেষ্টা করলে কি ধরা যায় না ওদের?
কিন্তু ভয় আর ব্যর্থতার ভয় একসাথে একটা অদ্ভুত অবসন্নতা এনে দিলো ওর মধ্যে। সব শব্দই যেন ভেঙে চূরে হারিয়ে যাচ্ছে এবার। অক্ষরহীন একটা অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকলো ও। বদ্ধ একটা ঘর, জানলা নেই , আকাশ নেই, টেবিলও নেই বোধহয়। বর্ণমালা যাওয়ার কালে রং কেও টেনে নিয়ে গেছে!

হঠাৎ একটা হাত এগিয়ে এলো, "চল তোকে উঠতে হবে"!

পাথরটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে,  সব কটা খাঁজ বুকে নিয়ে। দড়িটাও ঝুলে আছে,  উপরে একজন বসে আছে দড়িটা কোমরে জড়িয়ে , পড়ে গেলে যাতে বাঁচিয়ে নেওয়া যায়। আগে যেটা চোখে পড়ে নি ওর, সেটা হলো চারপাশে অন্য অনেকেই আছে, যারা ওই খাঁজ ধরে উঠে গেছে উপরে, কেউ অবলীলায়,  কেউ একটু কষ্ট করে।
শুধু বর্ণমালাটাই যা নেই।
আকাশ আছে, গাছ-গাছালি, পায়ে চলা পথও, কিন্তু কথা বলছে শুধু মানুষ!
পাথরের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো ও।  প্রথম ধাপটা এখন অংক. m , g , h কে ব্যালান্স করছে ফ্রিকশনের প্রতিক্রিয়া বল। প্রথম ধাপটা এখন শক্ত, কিন্তু এভারেস্ট নয়। 
প্রথম ধাপটা উঠে গেলো ও, সাহায্য নিয়েই। ভয়কে আর ভয় লাগছে না! লড়াইটা আর বর্ণমালা ফিরিয়ে আনার নয়, একটা উঁচু পাথর চড়বার। লড়াইটা আর একা একা ছায়াযুদ্ধ নয়, সহায় রয়েছে অনেকেই। লড়াইটা আর লড়াই-ই নয়. একটা সাধারণ চেষ্টা।
পরের ধাপ, আরো একটা ধাপ।  তিননম্বরে গিয়ে বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা। ভয় ফিরে  এলো বুঝি!
নিচে থেকে একটা চিৎকার-বিরক্তির নাকি উৎসাহের ও জানে না, শুধু একটা নাম কানে বাজলো, নামটা ওর। খাঁজে পা রেখে একটা ধাপ উঠলো ও।  আর একটা। তার পর আর ও একটা।
তারপর সামনে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ, অনেক নিচে ছোট্ট একটা নদী, আর কাছেই অন্য একটা পাথর ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। হ্যাঁ, হাসছে। পাথরটার ক্ষয় হয়েছে এমনভাবে, দুটো চোখের গোল আর একটা কান অবধি টানা হাসি পরিষ্কার বোঝা যায়, ঠিক যেন অভিনন্দন জানাচ্ছে উঠতে পেরে যাওয়ার জন্য।

মুখে এসে লাগছে মিষ্টি শীতের ঠান্ডা হাওয়া। হঠাৎ দেখলাম, হাওয়ার সাথে আমার দিকে ভেসে আসছে বাংলা বর্ণমালার অক্ষরগুলো, শব্দ হয়ে, বাক্য হয়ে, কবিতা হয়ে....

No comments:

Post a Comment