Search This Blog

Tuesday, July 4, 2023

ফের ভুল হলে

কক্ষনো ফের ভুল হলে শোন, কবিতা লিখিস মেঘ জমিয়ে;
বৃষ্টি এলে একটু ভিজিস, আমাকে না, ওদের নিয়ে -

গঙ্গা তীরের ময়লা শালুক, কুকুরছানা, কাবলিওলা 
লাল চা মাখা বিকেলগুলো, শুকনো পাতা, হারিয়ে যাওয়া,
চেনা গানের কথার ভুলে কিনতে চাওয়া আধখানা সুখ-
ক্ষয়ে যাওয়া পাহাড় বুকে  টলমলে জল, 'আয়না'য় মুখ! 

আমার আজো খেযাল করে বেখেয়ালি গল্প লেখা,
বুনছে ছিঁড়ছে আবার জুড়ছে হলদে খাতার ময়লা পাতা-
শরীর জুড়ে হিমেল হাওয়া উষ্ণতা তোর স্পর্শ দোষে,
তৃষ্ণা মেটায় তৃষ্ণা বাড়ায় স্মৃতির চুমোয়, আলগোছে!  

এক যে আছে ফেরিওলা, স্বপ্ন বেচে, রং মাখিয়ে-
সাত-সতেরো লোভ দেখিয়ে ঠকিয়ে যায় ঘুম ছিনিয়ে-
লোভের ভাগে শরীর পড়ে, দামের ভাগে 'ভালোবাসি',
ভুলের ভাগে অতীত পড়ে; আমার ভাগে  মুচকি হাসি!

কক্ষনো ফের ভুল হলে শোন, কবিতা লিখিস পাহাড় নিয়ে-
ঝর্ণা পেলে একটু ভিজিস, 'ভুল' হয়ে যাওয়া দিন মাখিয়ে! 
  

অন্য দরবারে

আভোগ জানো, সুরধনী ? 
শেষবেলাতে জ্বলে ওঠে? উপরের স্বর ছুঁয়ে
আছড়ে পড়ে নিচের তারে, সূর্য ডোবে অনন্ত জলরেখায়- 
সুর মেলানো বৃথাই তোমার, অসুর-পিয়াসি, 
মন বন্ধ করে  চিঠি লেখো তুমি  কোনো অন্য দরবারে।

জগৎ লুটেছে চরণে তোমার, তবু তুমি
খুঁজে ফের অবহেলা? দিগ্বিজয়ী মন , এ 
কোন খেলা ? জল ছুঁয়ে চুমু খেয়ে যায় 
এক পশলা বৃষ্টিমাখা হাওয়া, কোন কলকাকলি
 ভেঙে, কোন রক্তাম্ভর গোধূলিবেলায়-
 কান্না বাজে, বাতাস চিরে!  
মন বন্ধ করে, চিঠি লেখো তুমি, কোনো অন্য দরবারে !

 তুমি 'অ'সুখ জানো, ইন্দ্রজিৎ?
আলস্যে ফোটে রামধনু, মেঘের আড়াল থেকে-
সাতরং যদি কালো হয়ে, কারো বুকে শেলের মতো বাজে ? 
নিষ্ঠুর, তুলি, কলম, সব মিথ্যে তোমার, 
মন বন্ধ করে লেখো তুমি চিঠি, কোনো অন্য দরবারে! 

  

Friday, June 12, 2020

রাজনীতি এবং ছাত্রছাত্রীরা

এক টালমাটাল সময়ে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। ভূস্বর্গ কাশ্মীর সত্যিই 'ভয়ঙ্কর' হয়ে উঠছে দিনদিন, বাজারে আগুন লেগেছে, বিকিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় রেল, ভারত পেট্রোলিয়াম, এমনকি ভারতীয় পরিচয়টুকুও! হাতে  ভোটার, আধার , প্যান ইত্যাদি কমপক্ষে তিন- তিনটে সরকারি 'কার্ড' থাকলেও আমরা 'ভারতীয়'  কিনা তাই নিয়ে সন্দেহ দানা বেঁধেছে দেশের শাসকের মনে।

সময়টাকে একটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাক।  আজ থেকে দশ বছর পরের কথা। পেঁয়াজের দাম ছাড়িয়ে যাবে কমপক্ষে ২০০ টাকা প্রতি কেজি। ২০০৯ সালে পেঁয়াজের দাম ছিল সবোর্চ্চ ৩০ টাকা প্রতি কেজি, যা ২০১৯-এ এসে দাঁড়িয়েছে গড়ে ৮০ টাকা প্রতি কেজি। দশ বছরে এই রোজকার রান্নার উপকরণটির দাম বেড়েছে প্রায়  ২৬৭ শতাংশ! ততদিনে কিন্তু বিক্রি হয়ে গেছে  ৯০%  ভারতীয় রেল, দূরপাল্লার ট্রেনের ভাড়া বেড়ে প্রায় বিমানভাড়ার সমান। সরকার আর ভর্তুকি দেয় না রান্নার গ্যাসেও, কারণ ভারত পেট্রোলিয়ামও  আর  নেই সরকারের হাতে। দশবছর পরে, আজকের সদ্য গোঁফ ওঠা,  আঠেরো তখন কপালে ভাঁজ ফেলা আঠাশ। হাতে তার চাকরি নেই, আর যদিও বা  আজ 
চাকরি থাকে, কালকেও যে থাকবে সেই নিরাপত্তাটুকু নেই! হয়তো মাথার উপর বাবাও  নেই সেই যুবকের, কারণ দশ বছর আগে, এই ২০১৯-২০ তে, কয়েকটা কাগজের অভাবে তার বাবাকে যেতে হয়েছিল ডিটেনশন ক্যাম্প! সেদিনের সেই যুবক, আজকে এখনো ছাত্র, যাকে বারংবার তার শুভাকাঙ্খীরা সাবধান করছেন, "কলেজে যাচ্ছো যাও, ইউনিয়ন অফিসের ধারকাছ দিয়েও যেও না!" 

দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলিতে ঝড় বয়ে গেছে শেষ কিছু দিন ধরে।  ছাত্র-ছাত্রীরা বিক্ষোভ দেখিয়েছে, গলা তুলে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানিয়েছে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির বিরুদ্ধে। "কাগজ আমরা দেখাবো না" থেকে শুরু করে শিক্ষাক্ষেত্রে ক্রমহ্রাসমান সরকারি অনুদান, বেতনবৃদ্ধি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকে পুলিশ এবং সরকারি মদতপুষ্ট গুন্ডাদের দৌরাত্ব সবই উঠে এসেছে সেখানে। আর এই ছাত্রবিক্ষোভ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বস্তুত দুইরকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। একদিকে যেমন সরকার এবং হামলাকারীদের নিন্দায় মুখর হয়েছেন একাংশের মানুষ, তেমনি ছাত্রছাত্রীদের আদৌ এইসব বিক্ষোভমূলক কর্মসূচিতে থাকা উচিত কিনা, থাকলেও কতটা সক্রিয়ভাবে, তা নিয়ে নানা আলোচনায় সরগরম পাড়ায় মোড়ের চায়ের দোকান থেকে "ঘন্টা খানেক সঙ্গে সুমন"!    

কতকগুলো ঘটনা একটু দেখে  নেওয়া যাক-
 ঘটনা-১: 

২০১৭ সালে মিনিস্ট্রি অফ হিউমান রিসোর্স এন্ড ডেভেলোপমেন্ট ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি ( IIT )এবং  ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সাইন্স এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (IISER) গুলিতে পিএইচডি করার খরচবৃদ্ধির ঘোষণা করে।  বেতন বৃদ্ধি হয় প্রায় ২৭৬%.  IIT এবং IISER গুলিতে সেইভাবে সম্মিলিত ছাত্র সংগঠন বলে সেইভ কিছু গড়ে ওঠেনি আজও। ছাত্র-ছাত্রীরা এই  বেতন-বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানায় সোশ্যাল মিডিয়ায়, কিন্তু প্রতি সেমেস্টার  শেষে তাদের এই বর্ধিত বেতনটা আজও গুনতেই হয় ।

ঘটনা-২:

 ২০১৮ সালে পিএইচডি 'র ছাত্র-ছাত্রীদের  স্কলারশিপ বাড়ানোর দাবি অগ্রাহ্য করতে ব্যর্থ সরকার নিতান্তই চক্ষুলজ্জার খাতিরে  স্কলারশিপ 'বাড়ায়' মাত্র ২৪%. সঙ্গে সঙ্গে কমিয়ে দেওয়া হয় হাউস-রেন্টাল আল্লাওয়েন্স (৩০% থেকে কমিয়ে করা হয় ২৪%) .

ঘটনা-৩:

২০১৯ এর  সেপ্টেম্বরে  মিনিস্ট্রি অফ হিউমান রিসোর্স এন্ড ডেভেলোপমেন্ট  ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (IIT ) গুলিতে  M-Tech পড়ার খরচ বৃদ্ধি করে প্রায় ৯০০ শতাংশ। দেশ জুড়ে শিক্ষা  প্রতিষ্ঠান গুলিতে আবার শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন।  দিল্লির জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় সাংগঠনিক ভাবে শুরু হয় বিরোধ। এই  ছাত্র আন্দোলনের কাছে মাথা নত করে গত ডিসেম্বরে অবশেষে বেতন-বৃদ্ধিতে স্থগিতাদেশ ঘোষণা করেছে সরকার।   

এই তিনটে ঘটনার মধ্যে পার্থক্যটা কোথায় বলুন তো? প্রথম দুটি ঘটনায় ছাত্র-ছাত্রীরা সংঘবদ্ধ ছিল না।  তিননম্বর ঘটনাতে প্রতিবাদ এসেছিলো ঐক্যের হাত ধরে।  আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ছাড়া এই ঐক্য সম্ভব নয়, বিশেষত আমাদের মতো এতো বিরাট দেশে। 

যদি বলেন যে ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের সমস্যা নিয়ে প্রতিবাদ করুক, সমস্যা নেই, কিন্তু দেশের রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে তাদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই তাদের, হাজার হলেও "ছাত্রাণাং অধ্যয়নং তপঃ", তবে মনে করুন একটু আগেই যে আঠাশের যুবকটির কথা হচ্ছিলো।  আজকের দেশের সমস্যা আজ থেকে মাত্র দশ বছর পর গিয়ে তার নিজের সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে, তাহলে তার কি অধিকার নেই আজকের সমস্যার সমাধান খুঁজতে চাওয়ার? চলুন না একটা অন্যরকম স্বপ্ন দেখি, যেটার শুরু আজকের সদ্য তরুণ  ছাত্র-ছাত্রীদের দেশ, কাল এবং তার নানারকম সমস্যা নিয়ে একটু ওয়াকিবহাল হওয়া দিয়ে।  একটুখানি পড়ার বইয়ের বাইরের পড়াশোনা করা দিয়ে। একটুখানি মত-প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়ে।  দশ বছর পরে দেখবেন, হাসপাতালে ঢুকে সরকারি মদতপুষ্ট গুন্ডারা আর তরুণ ডাক্তারকে মেরে অন্ধ করে দিচ্ছে না, পাড়ার ক্লাস ফাইভ ফেল 'দাদা' স্কুলে ঢুকে M.Sc. করে আসা মাস্টারমশাইকে শাসাচ্ছে না। দেশটা হয়তো টিঁকে যাবে তাহলে এতকিছুর পরেও!

আর যদি মনে হয়  রাজনীতিতে জড়িয়ে গেলেই কেরিয়ারের সাড়ে-সর্বনাশ হয়ে গেলো, তাহলে একটিবার অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মনে করে নেবেন।  বাঙালির ছেলে, JNU তে পড়াকালীন রাজনৈতিক ছাত্রআন্দোলনে যুক্ত ছিলেন।  ১০ দিন জেল খেটেছেন আশির দশকে। গতবছর একটা নোবেল পেয়েছেন অর্থনীতিতে! উনি যদি ছাত্রাবস্থায় সক্রিয় রাজনীতি করেও একটা নোবেল পেতে পারেন, আমরা একটুখানি সময় দেশের জন্য ব্যয় করিই না! ১০ বছর পরে বাচ্চার দুধ-ভাত টুকু ঠিকই জোগাড় করে নেবো।    

Sunday, April 5, 2020

আমাদের দেশ

আমি পাহাড় দেখি প্রথম সূর্যের আলোর প্রত্যাশায়,
পাহাড় মুখ ফেরায় আমার থেকে।
রোদ ঝলমলে সূর্য ওঠে অন্য কোনোখানে,
অন্ধকারে ভরে যায় আমার দেশ;
অনাসৃষ্টির হাহাকারে ভরে যায় আমার দেশ!

আমি একদণ্ড শান্তি খুঁজি,
আমি জঙ্গলে ফিরে ফিরে যাই।
একদলা আগুন এসে পড়ে,
জ্বলে যায়, পুড়ে যায়, দাবানলে ছেয়ে যায়-
আগুনে ছারখার হয়ে যায় আমার দেশ,
অনাসৃষ্টির হাহাকারে ছেয়ে যায় আমার দেশ!

সন্ত্রস্ত, আমি দৌড়ে আসি প্রেমিকের বুকে,
মিষ্ট চুম্বনের আশ্বাসটির আখাঙ্খায়।
প্রেমিকের গাল বেয়ে নেমে আসে রক্ত,
ঠোঁট ছুঁয়ে জিভে লাগে নোনতা স্বাদ-
রক্তে ভেসে যায় আমার দেশ,
অনাসৃষ্টির হাহাকারে কেঁদে মরে  আমার দেশ!

আমি দেশের পানে চাই-
অরাজকতার অন্ধকার আর মাংসপোড়ার গন্ধ
ছাপিয়ে, 'আমরা' তলোয়ার ওঠায় -
'তোমারার' ওপর! আর রাজসিংহাসনে গদিয়ান
একদল নরপিশাচ তারিয়ে উপভোগ করে-
তোমার আমার কুরুক্ষেত্রের লড়াই!
আর যখন তোমার নিস্প্রান দেহের পাশে পড়ে থাকা
আমার পচা লাশ থেকে বিকট গন্ধ আসতে শুরু করে,
ধ্বংসের পদধ্বনি প্রকট হয়, আর শেষ বারের মতো
একবার ককিয়ে উঠে চুপ করে যায়,  আমাদের দেশ!

তোমায় বড় মনে পড়ে

তোমায় বড় মনে পড়ে,
আর তারপর, আমি মৃত্যু দেখি!

সকালবেলার কুয়াশামাখা শীতলতাকে বুকে জড়িয়ে
শূন্যমনে ঘরে ফেরার বেলা, উচ্চাশার চাবুক খেয়ে
উষ্ণতায় জলাঞ্জলি দেওয়া নির্বিকার ভোরে,
বিক্ষোভ, বিদ্রোহ, মিছিল নিরাপদে পাশকাটানো
মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া দুপুরে-

তোমায় বড় মনে পড়ে!
তুমি থাকলে, বলতাম "চলো এক পা হেঁটে আসি মিছিলে"!

তুমি থাকলে, দুনিয়া উজাড় করে
আমি ঠিক ফিরিয়ে আনতাম ভালোবাসা,
সাম্রাজ্যবাদের বুকের উপর দাঁড়িয়ে
আগুন জ্বালিয়ে দিতাম বিপ্লবের,
দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতাম, ফিরিয়ে দিতাম
প্রেম, এ হতভাগা দেশে। আর তারপর -

বৃষ্টি নামতো, মরুভূমির বুকে। মরা নদীর খাত
ভরে উঠতো টলটলে জলে- আর -
কোনো এক সন্ধ্যাবেলা, আধখাওয়া চাঁদটা,
সেই জলে তোমার-আমার প্রতিচ্ছবি  দেখে-
 হিংসা করে মেঘের আড়াল টেনে দিতো মুখের উপর!

তোমায় বড় মনে পড়ে নীল,
যখন চারপাশে মৃত্যু দেখি!

Wednesday, April 1, 2020

অন্ধকারের রূপকথা


পর্ব-১

রিজু 

নন্দিনীকে খুঁজছে ওরা। ওদের গলায় লম্বা রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে মোটা লোহার কড়া, টকটকে লাল চোখ নিয়ে রোজ আসে রাত্তিরে।  মা ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক পরে।  বাইরের ঘরে বসে সদ্য টুয়েলভে ওঠা রিজু ইন্টেগ্রেশনের প্যাচানো এসের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে যখন সবে ঢুলতে শুরু করেছে, ঠিক তক্ষুনি। "ব্যোম ভোলে" আওয়াজে ঘুম চটকে যায় রিজুর, জানলার পর্দাটা একটুখানি সরিয়ে উঁকি মারে। দেখে ওরা বসে গেছে ততক্ষনে রোজকার মতো লাল রাস্তার মাঝখানটায় গোল হয়ে। আগুন জ্বেলেছে, আর সেই আগুনের ধোঁয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছে ছ'ছটা লোক । ভীষণ ভয় করতে থাকে রিজুর; অঙ্ক খাতাটা জলদি জলদি বন্ধ করে টিপ্ টিপ্ পায়ে বাড়ির ভিতরের দরজায় যায়, তার পর এক ছুট্টে মায়ের পাশে। মা ঘুম চোখে বলেন, " সন্দীপ স্যারের কাজগুলো করেছিস তো বাবু  ?"
মাথাটা হেলিয়ে বিছানার পাশের টেবিলে রাখা বোতল থেকে  ঢক ঢক করে অনেকটা জল খায় রিজু। তারপর মায়ের গন্ধ মাখা বিছানায় সেঁধিয়ে যায় চুপচাপ।
প্রথম দিনটা অবশ্য এরকম ছিল না। মাসখানেক আগের কথা। সবে বৈশাখ পড়েছে। গরমের জন্যে পর্দাটা তোলা ছিল। ছটা  লোক রাত্তিরবেলা পাড়ার মাঝে এসে আগুন জ্বালিয়ে বসছে দেখে রিজু রীতিমতো ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে জিজ্ঞাসা করেছিল ব্যাপারখানা কি! ওদের কেউ উত্তর দেয় নি। নিজেদের মনে আগুন জ্বালানোর কাজে ব্যস্ত ছিল।  সুঠাম গড়ন সব্বার, বলিষ্ঠ চেহারা। উর্ধাঙ্গে রুদ্রাক্ষের মালা ছাড়া কিছু নেই, পরনে গেরুয়া ধুতি। রিজুর তখনি একটু ভয় করতে শুরু করেছিল, কিন্তু তবু সাহসে ভর করে একটু চেঁচিয়েই বলে উঠেছিল, " কে আপনারা? কি চাই? আগুন জ্বালাচ্ছেন কেন?"
ওরা তাও ফিরে তাকায় নি। উল্টে মা উঠে এসেছিলেন ঘর থেকে, " বাবু, চিৎকার করছিস কেন? ঘুমিয়ে পড়েছিলি? বারান্দায় কি করছিস ?"
মায়ের প্রশ্নে অবাক রিজু মায়ের দিকে তাকিয়েছিল,  "ওরা পাড়ার মধ্যে এসে আগুন জ্বালাচ্ছে কেন? জিজ্ঞাসা করলে উত্তরও তো দিচ্ছে না !"
মাও অবাক হয়ে বলেছিলেন, "কারা ? কে আগুন জ্বালাচ্ছে ? কি ভুলভাল বকছিস ? যা শুয়ে পড়, অনেক হয়েছে আজ পড়া !"
রিজু হতবাক মুখে ফের মায়ের দিকে তাকিয়েছিল "তুমি দেখতে পাচ্ছ না? ছজন সন্ন্যাসী... রাস্তার মাঝে ? সত্যি দেখতে পাচ্ছ না?"
মা ঘুমচোখে একবার হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, "নাঃ, এখনো পাচ্ছি না! চুপচাপ গিয়ে ঘুমো! কাল সকালে ক্লাস আছে আমার নটায়, উঠতে হবে তাড়াতাড়ি! সারাদিন উল্টোপাল্টা সিনেমা দেখছিস পরীক্ষা শেষ হয়ে অবধি! আর কি হবে! রাত্তিরে ভুলভালই দেখবি! চল !" প্রায় টেনেই  রিজুকে ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন সর্বানী।  এমনকি পিছন ফিরে দেখার সুযোগও পায়নি আর রিজু।
পরের দিন সকাল হলে রিজুরও মনে হয়েছিল যে ভুলই দেখেছে হবে সে, কারণ রাস্তাতেও আগুন জ্বালানোর চিহ্ন মাত্র ছিল না! কিন্তু সেই রাতে আবার আগের দিনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ! মাকে ডেকে আনবে কিনা ভাবতে গিয়ে থেমে গিয়েছিলো রিজু, "আগে দেখি ব্যাপারটা কি!" জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ও দেখেছিলো ছজন সন্ন্যাসীর আগুন জ্বালানো, ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে থাকা।  ঘন্টাখানেক হবে, রিজু দেখেছিল ওরা কিছুই করছে না, মাঝে মাঝে চাপা গলায়  "ব্যোম ভোলে" চিৎকার করা ছাড়া। তারপরেই ধোঁয়াটা হঠাৎ রং বদলাতে শুরু করেছিল। জায়গায় জায়গায় ফ্যাকাশে, জায়গায় জায়গায় গাঢ়, যেন কিছুর একটা আকার নিচ্ছে ধোঁয়াটা! একটা মুখ! খুব চেনা একটা মুখ রিজুর ! নন্দিনীর মুখ!
অস্ফুটে রিজুর মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিলো, "নন্দিনী!"
ছজন সন্ন্যাসী বসেছিল একটা বৃত্ত বানিয়ে। মুখোমুখি সবাই। চোখ সবার বন্ধ। রিজুর মুখ থেকে নন্দিনীর নামটা বেরোনো মাত্র খুলে গিয়েছিলো একসাথে বারোটা লাল চোখ আর ঠিক পরের মুহূর্তে সবকয়টা চোখ  ঘুরে গিয়েছিলো রিজুর জানলার দিকে!
একদম সেই সময়ে ঝপ করে পর্দাটা ফেলে একছুট্টে মায়ের ঘরে চলে এসেছিলো রিজু! ওরা নন্দিনীকে খুঁজছে!

পর্ব-২

বিনি

চাকরিটা হয়ে যাবে বলেই মনে হয় বিনির। ওর দাদু, মানে বাবার বাবা কলেজটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বিনিও এই কলেজেই পড়েছে, পড়াশোনাতেও ভালোই ছিল বরাবর। তারপর প্রবীরবাবু, মানে ওদের বিভাগের প্রধান যিনি, উনিও তো বলেই দিলেন যে একটা পোস্ট শুধু মেয়েদের জন্যেই রাখা।  ওকে বাদ দিয়ে আর একটাই তো মেয়ে এসেছিলো ইন্টারভিউ দিতে । এবার দেখা যাক।

বেশ খানিকটা দেরি হলো ইন্টারভিউ দিয়ে, পুরোনো স্যারদের সাথে গপ্পোগাছা করে ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরোতে। অনেকদিন বাদে কলেজে এসে বেশ ভালো লাগছে বিনির। শীতের দিন, সাড়ে ছটা মানে বেশ ভালো রকম সন্ধ্যে। ক্যান্টিনে গিয়ে এককাপ চা দিতে বললো বিনি  ভোলাদাকে। চা'টা খেয়ে বাড়ি যাবে। বাড়ি তো নয়, বিনির নিজস্ব জেল ওটা ! অসহ্য লাগে ওর ওই বাড়িতে ফিরতে, ঢুকতে, থাকতে!

শাড়ির আঁচলটা দিয়ে কপালটা মুছলো বিনি ! চাকরিটা হলে প্রথম কাজ যেটা করবে ও , সেটা হলো ওই বাড়ি থেকে, অজিতদার বাড়ি থেকে,  বেরিয়ে আসবে। কলেজের কাছেই একটা মেয়েদের পিজি দেখা আছে ওর। আপাতত সেখানে। কতদিন ধরে শুধু এইদিনটার অপেক্ষায় আছে ও। মায়ের ছোট মেয়েকে নিয়ে মা এবং অজিতদা, দুজনকারই  আদিখ্যেতা দিন দিন বেড়ে চলেছে দিনদিন! সহ্য হয় না বিনির। একদম সহ্য হয় না।  অজিতদাকে, মাকে কাউকে না।  আর ওই মেয়েটা তো চক্ষুশূল ওর।  মেয়েটা মানসিক ভারসাম্যহীন, সাত বছর বয়স, কিন্তু এখনো ঠিক করে হাঁটতে শেখে নি, সারাক্ষন ঠোঁটের পাশ দিয়ে লালা ঝরছে।  আধো আধো বুলিতে আম্মাঃ আম্মাঃ করে মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরছে সর্বক্ষণ! বিনি তো একদম পাত্তা দেয়  না ওকে।  অজিতদাকেও না।  অজিতদা আর মা'র বিয়ের আজ বছর পাঁচেক হয়ে গেলো, কিন্তু  অজিতদাকে বিনি এখনো অজিতদাই  বলে, মায়ের হাজারবার বলার পরেও।  ইচ্ছে করে, মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বেশি করে বলে।

মা মাঝে মাঝে কান্নাকাটি করেন, "কি চাইছিলি তুই? ওবাড়িতে পড়ে থাকি? তোর পড়াশোনা হতো ওখানে থাকলে?"

কথাটা সত্যি। ঠাকুরদা ছাড়া 'ওবাড়িতে', বিনি বা মায়ের শুভাখাঙ্খী কেউ ছিল না।  বিনির বাবা মারা গেছেন আজ থেকে সাত বছর আগে। বিনির মাধ্যমিকের আগে আগে।  রাতেরবেলা হঠাৎ কিছু আওয়াজ পেয়ে বারান্দায় যান, কিছুক্ষন পরে একটা ভয়াবহ প্রানপন চিৎকার আসে বারান্দা থেকে। মা, ঠাকুরদা, জেঠু সকলে দৌড়ে বারান্দায় গিয়েছিলেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু তারমধ্যেই  সব শেষ। বিনিকে বাড়ির লোক  বাবাকে দেখতে দেয়নি, বলেছিলো 'ভয় পাবি '! বাবার মুখ নাকি বীভৎস ভয়ঙ্কর ভাবে বেঁকে গিয়েছিল, যেন কিছু দেখে খুব খুব খুব ভয় পেয়েছেন। ডাক্তার বলেছিলো হার্ট এট্যাক! বিনির মনে আছে, ঠাকুরদা ওকে সঙ্গে নিয়ে চুপ করে বসেছিলেন ছাদে, যতক্ষণ না জেঠু আর অন্যরা ফিরছে দাহ করে। বিনি কাঁদছিলো, খুব কাঁদছিলো। ঠাকুরদা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন আসতে আসতে। নিচের ঘরে  মা ঘন ঘন অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। তিন্নি তখন মায়ের পেটে। এই ঘটনার পর বেশিদিন না, মাত্র দুমাসের মাথায় তিন্নি জন্মায়, সাতমাসের বাচ্চা, প্রিমাচিওর বেবি।
তিন্নি জন্মানোর পর, জেঠিমা একরকম ঘোষণা করে দেন, "ওই মেয়ের  জন্যেই সুব্রতটা...", আঁচলের খুঁটে শুকনো চোখ মুছতে মুছতে, "রাক্ষুসী পেটে ধরেছিলি ছোট! সব খাবে, সব...."

মায়ের না ছিল নিজস্ব কোনো আয়, না ছিল বাপের বাড়ির জোর। দিনের পর দিন জেঠিমার সংসারে বিনাপয়সার ঝি হয়ে উঠছিলো মা, তিনমুখে খাবার যোগান দেওয়ার জন্যে।   বিনি পড়াশোনায় ভালো ছিল ওর জেঠতুতো ভাইবোনদের চেয়ে, সেই জন্যেই বোধহয় বিনিকে দিয়েও সংসারের কাজ করিয়ে নিতে ছাড়তেন না জেঠিমা। ঠাকুরদা কিছু বলতে এলে তাঁকেও কথা শুনতে হতো।

অজিতদা ওবাড়িতে আসতো দীপাকে অঙ্ক করাতে। অজিতদা বিনিদের স্কুলেরই অংকের টিচার, তখন বয়েস হবে ২৭ কি ২৮।  নতুন জয়েন করেছিল, বাবা যে বছর মারা যান, সেই বছরে। জেঠু ওই স্কুলেরই ক্লার্ক ছিলেন, ধরে এনেছিলেন মেয়েকে পড়ানোর জন্যে। অজিতদা পড়াতো খুব ভালো,  ক্লাস ইলেভেন-টুয়েলভের মেয়েদের মধ্যে অজিতদাকে নিয়ে বেশ আলোচনাও চলতো ,পড়াশুনো, এবং আনুষঙ্গিক নানা বিষয়ে। বলতে নেই, সেই দলে বিনি নিজেও  ছিল। ওই স্কুল থেকেই অজিতদাকে অজিতদা বলার স্বভাব বিনির। ওদের স্কুলে ওরা মাস্টারমশাইদের 'দাদা' আর দিদিমণিদের 'দিদি' বলেই ডেকে এসেছে।

একা থাকতো অজিতদা, সেনকাকুদের বাড়িটা ভাড়া নিয়ে। সেনকাকুরা কলকাতায় থাকেন চাকরির জন্যে। বিয়ের পরে মা, তিন্নি আর বিনিকে নিয়ে ওখানেই উঠেছিল। ওই বাড়িতেই এখনো থাকে ওরা, শুধু বাড়িটা এখন অজিতদা কিনে নিয়েছে। বিয়েটা ওরা করেছিল বিনি হায়ার সেকেন্ডারি পাস করার পর, যাতে স্কুলে ওকে কোনো অস্বস্তিতে না পড়তে হয়।  বিনির মনে আছে পরিষ্কার সেই দিনটা।  আগের দিন হায়ার সেকেন্ডারি শেষ হয়েছে ওর, পরেরদিন সকালে ঠাকুরদা ওকে ডেকেছিলেন।

 "বিনিমা , অজিতকে তুমি তো চেনো?"
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল বিনি, পরের কথার জন্যে একেবারে অপ্রস্তুত।
-"তোমার মাকে অজিত বিবাহ করতে চায়।  অতিকষ্টে তোমার মাকে রাজি করিয়েছি, তোমার কোনো আপত্তি নেই তো? "

যেন বিনির আপত্তিতে কিছু আটকাবার ছিলো! দাদু ওকে প্রতিবাদ করার সুযোগ না দিয়েই একেবারে বলে গিয়েছিলেন কবে কোথায় বিয়ে, বিয়ের পর কি হবে, কে কোথায় থাকবে, এমনকি উনি রোজ আসবেন ওর আর তিন্নির সাথে দেখা করতে, যতদিন না মারা যান!

দাদু অবশ্য আসতেন রোজ, দুবছর আগে অবধিও। দুবছর আগে বিনির এম. এসসি তে ভর্তি হওয়ার দিন দাদু মারা যান।  সন্ধ্যেবেলা রিকশা চড়ে আসছিলেন অজিতদার বাড়ির দিকে, মানে যেখানে ওরা  থাকে এখন; হার্ট এট্যাক।  জেঠু-জেঠিমা মা, বিনি, তিন্নি কাউকে ঘেঁষতেও দেননি দাদুর মৃতদেহের আসে পাশে, কিন্তু কানাঘুষোয় শুনেছে বিনি, দাদুর মুখেও নাকি ছিল এক অস্বাভাবিক ভয়ের ছাপ, ঠিক যেমন ছিল বাবার মুখে!

 এখন সাত বছরের তিন্নি আধো আধো বুলিতে অজিতদাকে "বাব্বাঃ" বলে, আর মা নিজের থেকে প্রায় দশ বছরের ছোট স্বামীর সাথে সুখে সংসার করে।  একমাত্র গলার কাঁটা ওদের বিনি! চাকরিটা হোক , বিনি নিজেই সরে যাবে ওদের সুখের সংসার থেকে!
ভোলাদা চা দিয়ে গেছে। বেশ জমাটি একটা অন্ধকার নেমেছে বাইরে।  চায়ের কাপটা ঠোঁট ছুঁয়েছে মাত্র, বিনি দেখলো হন্ত-দন্ত হয়ে উস্কো -খুশকো চুল নিয়ে ক্যান্টিনে ঢুকছে  বিতান। বিতান ওর জেঠুর ছেলে, ভাইবোনদের মধ্যে একমাত্র ওর সাথেই বিনির যা একটু জমে! বিতান মায়েরও খুব ন্যাওটা, জেঠিমার বারণ গ্রাহ্য না করে প্রায় রোববার মায়ের কাছে লুচি খেতে চলে আসে!

বিতানের চোখ উদ্ভ্রান্তের মতো, কাউকে খুঁজছে! ডান-বাম ঘুরে বিনিতে এসে স্থির হলো ওর চোখদুটো, -"বিনি, এক্ষুনি বাড়ি চ! এক্ষুনি! কাকিমা নেই....অজিতকাকাও..."..গলাটা ধরে এসেছে বিতানের!
চায়ের কাপটা পড়ে গেলো হাত থেকে বিনির, আর তারপর  কোনোরকমে প্রায় না শুনতে পাওয়ার মতো করে, অস্ফুটে দুটো শব্দ বেরলো ওর গলা দিয়ে .."ক-কি হয়েছে?"
চোখের জল মুছে বিতান বললো, "হার্ট এট্যাক!"



পর্ব-৩

রিজু 


অরুণাভদা হোমটাস্ক দিয়েছিলো, দোয়ারী-মজুমদার-মাইতির বই থেকে দশটা শক্ত অঙ্ক। ফিজিক্স বরাবরের প্রিয় সাবজেক্ট রিজুর, কিন্তু গত একমাসে পড়াশোনায় একদমই মন বসাতে পারছে না ও। অনেকক্ষণ ধরে দুটো অঙ্ক মেলাতে পেরেছে কোনো রকমে। অরুণাভদা যদি দেখে রিজু ১০টার মধ্যে মাত্র দুটো অঙ্ক করতে পেরেছে, নির্ঘাত মাকে জানাবে । বইটা বন্ধ করে রিজু ভাবলো একবার সৌম্যকে ফোন করবে কিনা। সৌম্য ফার্স্ট হয়, ও ঠিক করে ফেলেছে প্রবলেমগুলো।

রিজুর নিজের ফোন নেই, মাধ্যমিকের পর বাবা কিনে দিতে চেয়েছিলেন, মা বারণ করেছেন। উচ্চমাধ্যমিকের পর বলেছেন কিনে দেবেন। কম্পিউটার আছে, কিন্তু ইন্টারনেট মা'র ফোন থেকে কানেক্ট করতে হয়। একটা পুরোনো নোকিয়া ফোন আছে বাড়িতে, এমার্জেন্সির জন্যে। সৌম্যকে সেটা থেকেই ফোন লাগালো রিজু, বিপ বিপ যান্ত্রিক শব্দ জানান দিলো সৌম্য ব্যস্ত।

ফোন রেখে রিজু বইয়ের আলমারির কাছে গেলো। ফোন, ইন্টারনেট না থাকায় রিজুর খালি সময় বই-পত্র পড়ে কাটে।  প্রচুর বই ওদের বাড়িতে; গল্পের বই তো আছেই, সঙ্গে অঙ্ক-বিজ্ঞানের বইও ভর্তি। এগুলো সবই মায়ের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া, মা'র বাবার বই, কিছু মায়ের দাদুর। বইয়ের আলমারি থেকে 'ম্যাজিকের অঙ্ক' বলে একটা বই নামালো রিজু, প্রথম পাতায় কালির কলম দিয়ে লেখা "অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য সর্বানীকে দাদুভাই" ; মাকে মায়ের দাদু উপহার দিয়েছিলেন তবে বইটা।
মায়ের দিকের ফ্যামিলির সাথে এক্কেবারে যোগাযোগ নেই রিজুদের।  এমনকি মাকে কোনোদিন সেভাবে বলতেও দেখেনা ও বাড়ির লোকের কথা।  মামারবাড়ি কখনো যায়নি রিজু নিজের ১৬ বছরের জীবনে। কাউকে চেনেওনা ও মামারবাড়ির।

শুধু নন্দিনীকে ছাড়া।

শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমস্রোত নেমে গেলো রিজুর। নন্দিনীর নামটা মনে আসতেই সেই  রাতের রাতের  বারোখানা লাল চোখ মনে পড়ে  যায় আজকাল ওর, আর খুব ভয় করে। চারদিকটা কালো হয়ে আসে, একটা খিলখিল করে হাসি শুনতে পায় রিজু। নন্দিনীর হাসি। হাঁটুর নিচে থেকে  পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে, রিজুর মনে হয় ও আর ইহজগতে নেই। তীব্র একটা হাওয়া ঝাপটা মারে ওর সারা শরীরে, বৈশাখ মাসের গরমে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে ও, যেন কেউ একবালতি বরফ গলানো জল ঢেলে দিয়েছে রিজুর মাথায়। আশে-পাশের শব্দ খুব ক্ষীণ হয়ে যায়, শুধু ঝিঁঝির ডাকের মতো একটানা একটা শব্দ শুনতে পায় ও; আর বুকের ভিতর একটা নাম না জানা কষ্ট নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে কখন কাটবে এই আচ্ছন্ন অবস্থাটা ।

সেই জন্যেই আজও প্রথম ফোনের আওয়াজটা কানে আসে  নি ওর। যখন ও ফোনটা  ধরে, সৌম্য সেটা তিন নম্বর বার ফোন করছে ওকে।

"কিরে ফোন ধরছিস না কেন? শোন তোর বাড়ি আসছি এক্ষুনি, আমি, পলা আর দিপু।অরুণাভদার  শেষ দুটো অঙ্ক হচ্ছে না কারোর, তোর থেকে টুকবো; আর নাজির জন্মদিনের প্ল্যানিংটাও করে ফেলবো আজই----"

সৌম্য যখন কথা বলে, রেলগাড়ি ছোটায় পুরোপুরি। ধাতস্থ হয়ে গোটা ব্যাপারটা বুঝতে রিজুর খানিকক্ষণ লাগলো। অরুণাভদার হোমটাস্ক! করতে বসেছিল বটে ও, আজই একটু আগে ! কতদিন আগের কথা মনে হচ্ছে সেটা এই মুহূর্তে। কিন্তু অঙ্ক গুলো তো ওরও হয় নি!

সৌম্য পাক্কা ৫ সেকেন্ডের একটা বিরতি নিলো রিজু মাত্র দুটো অঙ্ক করতে পেরেছে শুনে। তারপর একবার নিজে উচ্চারণ করলো কথাটা, "তোর মাত্র দুটো অঙ্ক হয়েছে!"
কয়েক সেকেন্ড পরে রিজু পলার গলা শুনতে পেলো ফোনের ওপাশ থেকে, "রিজু, আমরা আসছি তোর বাড়ি, এক্ষুনি। "


পর্ব-৪

বিনি

বিনির আজ বিয়ে। ওদেরই কলেজের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের সঞ্জীবের সাথে। বিনি কেমিস্ট্রির; বিনিদের এইচ .ও.ডি প্রবীরবাবু সম্বন্ধটা  এনেছিলেন।  মা আর অজিতদার মৃত্যুর পর প্রবীরবাবু যা করেছেন ওর জন্যে, তা কখনো ভোলার নয়।  অবশ্য ওই সময়টা অপ্রত্যাশিত ভাবে বিনির জেঠু জেঠিমাও খুব হেল্প করেছিলেন; তার পরে একটা গোটা বছর কেটেছে, মোটামুটি খোঁজখবর রেখেছেন ওঁরা, বিতানকে দিয়ে মাঝে মাঝে পাল-পার্বনে এটা-সেটা পাঠিয়েওছেন। আজও আসবেন বলেছেন রেজিস্ট্রির সময়; অন্য কোনো  অনুষ্ঠান করছে না ওরা।

মা আর অজিতদার কাজের দিনই প্রবীরবাবু ওকে জানিয়েছিলেন চাকরিটা ওর হয়ে গেছে। একটু হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল বিনি! সাত বছরের তিন্নিকে নিয়ে নাহলে অথৈ জলে পড়তে হতো।  ভাগ্গিস বাড়িটা অজিতদার কেনা ছিল, নাহলে মাথার ওপর ছাদটুকুও থাকতো না।  সেইদিন বিতানের সাথে বাড়ি ফিরে বিনির পায়ের নিচে ভূমিকম্প হয়ে গিয়েছিলো! বাড়ি ভর্তি লোক, বারান্দায় সাদা চাদর চাপা দেওয়া দুটো দেহ! বারান্দারই এককোনে ছোট্ট তিন্নি বসে আছে চুপ করে, কাঁদছে না, কোন কথা বলছে না, কাউকে কাছেও  আসতে দিচ্ছে না! বিনি যে কিভাবে নিজেকে সামলেছিলো ওই জানে।

তিন্নি! মা মারা যাওয়ার পর থেকে মেয়েটা চুপ হয়ে গেছে। এমনিতেও ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না, এখন তো আর চেষ্টাও করে না।  এক কোনে বসে কয়েকটা ছবির বই নিয়ে নাড়াচাড়া করে, শান্ত ভাবে খেয়ে নেয় ডাকলে, আর মাঝে মাঝে বিনি দেখেছে বারান্দায় গিয়ে কাঁদে, কোনো আওয়াজ না করে । মা ওকে স্কুলে পাঠাননি, বাড়িতেই অক্ষর চেনানোর চেষ্টা করেছিলেন, বিনি দেখেছে ও একটু একটু পড়তেও পারে। খুব কষ্ট করে, কিন্তু পারে। যে তিন্নিকে বিনি দুচোখে দেখতে পারতো না, আজকাল বড্ডো  মায়া হয়।  বেচারা।

বিতানের ব্যবহার আবার ঠিক উল্টো হয়েছে তিন্নির সাথে, বিতান আগে ওদের বাড়ি এসে তিন্নির সাথে খুব খেলাধুলো করতো। আজকাল এড়িয়ে যায়। এটা সম্ভবত  জেঠিমার জন্যে। জেঠিমা বিনিকেও বোঝাতে এসেছিলেন মায়ের মারা যাওয়ার পর পর, তিন্নিকে কোনো অনাথ আশ্রম-টাশ্রমে দিয়ে আসতে; তিন্নির ভিতরে রাক্ষুসী আছে! এই সব মৃত্যুর জন্য নাকি তিন্নিই দায়ী! বিনি কানে নেয় নি, যত্ত কুসংস্কার! ওর আর আছেই বা কে তিন্নি ছাড়া। যদিও এতগুলো মৃত্যু, সবই  একই  রকম ভাবে, মাঝে মাঝে ভাবলে গা ছমছম করে বিনির। বিতান ওকে মা আর অজিতদার মুখ দেখতে দেয় নি; বলেছিলো, "দরকার নেই, ভয় পাবি!" কিন্তু ডাক্তার তো পরিষ্কার বলেছেন হার্ট এট্যাক, বিনি জোর করে নিজেকে ভাবায়, বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে এইসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করার কোনো মানে হয় না!

সঞ্জীবকেও কথাটা পরিষ্কার জানিয়েছিল বিনি, ও তিন্নিকে ছেড়ে থাকবে না। সঞ্জীব গ্রামের ছেলে, চাকরি পাওয়ার পর  এখানে একটা মেসে থাকতো, এবার থেকে ওর আর তিন্নির সাথেই থাকবে। সঞ্জীবের বাড়িতে আছেন  ওর বাবা আর মা, তাঁরা থাকেন বেশ দূরে একটা গ্রামে। বিনি ওনাদের সাথে কথা বলেছে, বেশ সরল সাধাসিধা মানুষ। সঞ্জীবের বাবা গ্রামের স্কুলের টিচার, কথা বলে মনে হয়েছে ভদ্রলোক বেশ পড়াশোনা করা মানুষ। সঞ্জীবের বৌয়ের বাড়ি থাকা নিয়ে ওর মায়ের একটু সমস্যা ছিল, যেটা সঞ্জীবের বাবা নিজেই ওনার সাথে কথা বলে মিটিয়েছেন। বিনি সব মিলিয়ে বিয়েটা নিয়ে খুশিই বেশ।

আপাতত বিনি বাড়ির বসার ঘরে অপেক্ষা করছে বিতানের আসার জন্যে, বিতান ওকে নিয়ে যাবে বলেছে রেজিস্ট্রি অফিস।  তিন্নি একটু দূরে বুকশেল্ফের কাছে মেঝেতে বসে একটা বই খুলে  এক মনে তাকিয়ে আছে। বসার ঘরের পাশে একটা বারান্দা, বারান্দা আর ঘরের মধ্যে পর্দাটা হাওয়ায় উড়ছে একটু একটু। বিনি একটা নিশ্বাস নিলো; মা থাকলে খুব খুশি হতেন। বাবার আর ঠাকুরদার  কথাও মনে পড়ছে; বাবা বলতেন আমার বিনিমার যেদিন বিয়ে হবে, গোটা শহর তাকিয়ে দেখবে! বিনি পর্দাটার দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে গিয়েছিলো একটু।

হঠাৎ তিন্নির তীক্ষ্ণ চিৎকারে ওর সম্বিৎ ফিরলো। হাতের বইটাকে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে চিৎকার করছে তিন্নি , ভয়ের চিৎকার নয়, রাগের চিৎকার। প্রচন্ড রাগে অসহায় হয়ে যেরকম চিৎকার  বেরোয়, ঠিক সেইরকম !
বিনি তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে পিঠে হাত রাখে তিন্নির, "কি হয়েছে, তিন্নি ?"
তিন্নি এর আগে কখনো দিদির থেকে এরকম ব্যবহার পায়নি। মা আর অজিতদা  মারা যাওয়ার পরও বিনি ওর আর তিন্নির মধ্যে দেওয়ালটা ভেঙে ফেলতে পারেনি, তিন্নির জন্যে মায়া হতো  ওর ঠিকই, কিন্তু ও কখনো কাছে ডেকে আদর করেনি বোনকে। দিদির মুখের দিকে তাকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে নির্বোধ আট বছরের মেয়েটা, তারপর দিদিকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে, কাঁদতেই থাকে।

বিনি বোনের মাথাটা একহাতে বুকে জড়িয়ে রেখে, অন্য হাতে বইটা কাছে টেনে আনে, "ছবিতে ছোটদের রামায়ণ" ; একটা পাতা খোলা, যেখানে কয়েকজন সন্ন্যাসী গোল হয়ে বসে কিছু যজ্ঞ-টজ্ঞ করছেন! বিনি অবাক যায় , এই ছবিটা দেখে তিন্নির এত রাগ হলো কেন হঠাৎ!

পর্ব-৫
রিজু 

অন্ধকার মতো একটা ঘর।  চারটে দেওয়ালের তিনটে দেওয়াল জুড়ে কাঠের আলমারি, কাঁচ লাগানো, আর তাতে থরে থরে সাজানো বই। ঘরের একদিকে  একটা তক্তপোশ, তাতে একজন মানুষের কোনো রকমে শোয়ার একটুখানি মতো জায়গা, বাকিটায় বই ছড়ানো।  তক্তপোশের পাশের জানলার কাছে একটা আরামকেদারা, তাতে হেলান দিয়ে এক ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধ, চোখে চশমা লাগিয়ে হাতে পুরোনো, হলুদ হয়ে যাওয়া একটা খেরোর খাতা খুলে তার দিকে তাকিয়ে আছেন।
তক্তপোশের ওপর জড়োসড়ো হয়ে তিন কিশোর আর এক কিশোরী বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে আছে, উদগ্রীব হয়ে।

অপালা, সৌম্যদীপ, দীপায়ন, আর নাজিয়া, এই চারজন রিজুর ছোট্টবেলার বন্ধু,  কতটা ছোটোবেলার, সেটা রিজুর আর  এখন মনেও  পড়ে না। ওরা পাঁচজন কথা বলতে না পারার বয়স থেকে একসাথে খেলাধুলো করেছে, পড়াশোনা করেছে ; বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নেয় রিজু, ওরা পাঁচজন, আর নন্দিনী।

জোর করে নন্দিনীর চিন্তাটা মাথা থেকে দূরে সরায় রিজু, চারপাশটায় একবার চোখ বুলোয় বদলে। পলার বইদাদুর বাড়ি এটা। ওরা সকলেই বই-পত্র পড়ে, কিন্তু পলা, মানে অপালা, বই পড়ে না, বই গলাধঃকরণ করে।  বইদাদু ছিলেন ওদের শহরের লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান, সেখানেই পলার সাথে ওনার আলাপ, আর এখন বইদাদুর বাড়িতে পলার যাওয়া-আসা প্রায় নিয়মিত। আজ দুপুরে সৌম্য ফোন করার পরে দিপু , পলা, আর সৌম্য ওর বাড়িতে এসেছিলো। স্বভাবচাপা রিজু ওর বন্ধুদের কিছু না বললেও ওরা গত একমাসে ওর ব্যবহার লক্ষ্য করে আগে থেকেই সন্দেহ করেছিল কিছু একটা সমস্যা আছে।

"আমি একটা জিনিস বুঝছি না, কাকিমা দেখতে পেলেন না বলে তুই আমাদের কাউকেও বললি না ব্যাপারটা ? প্রথমদিন চোখের ভুল  পারে, তার পর? কত বড়ো গাধা তুই ?"

সৌম্যর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিলো ও  রীতিমতো রেগে গেছে  সব শুনে।

রিজুদের বসারঘরে ছিল ওরা চারজন।  রিজু দরজার ফাঁক দিয়ে বারান্দার দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক  ভাবে বলেছিল, "ভেবেছি অনেকবার বলি তোদের, কিন্তু বিশ্বাস করবি কি না; তারপর ওই চোখের চাহনি! উফফ! যদি তোরা না দেখিস, ভাবতে পারবি না; খুন করে দেবে মনে হয়! তারপর ব্যাপারটা নন্দিনী রিলেটেড! বলতে গেলে মনে  হয়েছে যদি  তোদের কিছু হয় ? তার উপর নাজিয়ার কেসটা নিয়ে সবাই তোরা চিন্তায় ছিলি! সব মিলিয়ে.."

সৌম্য আরও রেগে বলেছিলো, "সেই জন্যেই, সেই জন্যেই তোর আরও বেশি করে বলা উচিত ছিল।  দেখ  ভাই,  আমি যুক্তি দিয়ে ভাবি।  আমার মনে হয় নাজিয়ার কেসটা তোকে হার্ট করেছে, যেটা  স্বাভাবিক, আফটার অল নন্দিনীর ব্যাপারটা এখনো মেটে নি। আর তুই নন্দিনীর সব থেকে ক্লোজ ছিলি। এটা একটা PTSD র মতোও তো কিছু একটা হতে পারে! তুই আজই কাকিমার সাথে কথা  বলবি এটা নিয়ে। আমি থাকবো যদি তুই চাস; আমরা সবাই থাকবো!"

রিজু সৌম্যর দিকে তাকিয়ে ঘাড় নেড়েছিলো ঠিকই, কিন্তু ওর মন বিদ্রোহ করে উঠেছিল, ছয়জন সন্ন্যাসী নন্দিনীকে খুঁজছে, এটাই সত্যি।  নাজিয়ার সাথে, বা রিজুর মানসিক কন্ডিশন-এর সাথে এর কোনো  সম্পর্ক নেই।
সৌম্য খুশি হয়ে বলেছিলো, "বাঃ, এই তো, ভালো ছেলে! এইবার আমার খাতা থেকে অঙ্কগুলো টুকে নে, তারপর নাজিয়ার জন্মদি-"
পলা হঠাৎ ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠেছিল, "রিজু, তুই ছজন সন্ন্যাসী বলেছিলি না? আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে ? সবার চেহারা ভালো ?"
দিপু, সৌম্য, রিজু তিনজনেই ওর দিকে তাকিয়েছিলো একসাথে; রিজু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেছিল;

পলা এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়েছিল, "চল, আমাদের বইদাদুর বাড়ি যেতে হবে। তুই যা বলছিস, সেটা এক্সাক্টলি মিলে  যায় শৃঙ্খলকদের বর্ণনার সাথে!"
-"শৃঙ্খলক ?" সৌম্যর হতবাক প্রশ্ন ;
-"হ্যাঁ, আমাদের আরশিপুরের একটা হাতে লেখা ইতিহাস আছে, সেখানে আছে এই শৃঙ্খলকদের কথা;  সেই বইটা  আছে বইদাদুর কাছে। আমি বছর দুয়েক আগে পড়েছিলাম।  সেরকম কিছু মনে নেই, কিন্তু এইটুকু মনে আছে, এই শৃঙ্খলকরা যখন দেখা দেয়, তখন একের পর এক অঘটন ঘটতে থাকে। শিগগির চল!"

রিজু উঠে দাঁড়ায়;  দিপুও।  সৌম্য পলার দিকে তাকিয়ে একটা বিরক্ত গলায় বলে ওঠে, "তোর না, সারাক্ষণ এইসব গুল গল্পের বই পড়া বন্ধ করা উচিত! শৃঙ্খলক, অঘটন! বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছিস কেন বলতো ? এক্ষুনি একটা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিলাম তো আমি ? তা না, শৃঙ্খলক, অঘটন!"
পলা সৌম্যর দিকে স্থির চোখে তাকায়, "সৌম্য, তুই যা বলছিস, সেটা হতে পারে।  কিন্তু বিজ্ঞান আজও সব কিছুর ব্যাখ্যা করতে পারে না।  আমি শুধু এইটুকু বলছি, একবার বইদাদুর বাড়ি গিয়ে গল্প শুনছিস ভেবে শৃঙ্খলকদের কাহিনীটা শুনে আয়  অন্তত ? তাতে তো কোনো ক্ষতি নেই ?"
তার পর মাটিতে চোখ নামায় পলা, "আর রিজু বলেছে এক মাস আগে এই ঘটনাটা শুরু হয়েছে। নাজিয়ার কেসটাও কিন্তু ওইসময়েরই।  সেটা কিন্তু একটা অঘটনই, সৌম্য। "
সৌম্য পলার দিকে একবার তাকিয়ে সাইকেলের চাবিটা তুলে নিয়েছিল, আর কোনো কথা বলে নি।

আপাতত ওরা চারজন বইদাদুর তক্তপোশে, বইদাদু তাঁর কোনো এক পূর্বপুরুষের হাতে লেখা "দর্পনপুরের অজানা ইতিহাস" খুঁটিয়ে দেখছেন শৃঙ্খলকদের নিয়ে কি কি তথ্য পাওয়া যেতে পারে। গোটা ঘরে থমথমে এক নীরবতা; এমনকি সৌম্যও কোনো কথা বলছে না।
ওরা সবাই একই কথা ভাবছে, পলা যখন ওদের সাথে বইদাদুর আলাপ করায়, রিজুর সাথে পরিচয়ের পর বইদাদু চশমাটা একটু নামিয়ে  ওকে জিজ্ঞাসা করছিলেন,
-"গোকুলবিহারীর নাতি ?"
রিজুর মৌন সম্মতির পরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, "পলা দিদিভাই, তিননম্বর আলমারির চারনম্বর তাক। "

অবাক পলা  তিন নম্বর আলমারির দিকে যেতে যেতে বলেছিলো, "তুমি কি করে জানলে, কোন বই ?"
ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধ মলিন হাসি হেসে বলেছিলেন, "কারণ ও বইটা শেষবার গোকুলবিহারীরই  কাজে এসেছিলো, দিদিভাই।  এই জিনিস গুলো একটা চক্রে ঘটে।  মানুষ শৃঙ্খলা ভাঙে, দিদিভাই, প্রকৃতি নয়; আর তখনি, শৃঙ্খলকদের ডাক পড়ে!"


পর্ব-৬

বিনি 

প্রবল বৃষ্টির মধ্যে  কলেজ থেকে  হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরেছে বিনি, বেশ ক্লান্ত লাগছে;  সাধারণত সঞ্জীবের সঙ্গেই ওর স্কুটারে ফেরে, কিন্তু কালরাতে সঞ্জীব সিঁড়ি থেকে পড়ে পায়ে হালকা একটা চোট লাগিয়েছে, আজ আর সে কলেজ আসে নি ।

গোটা ব্যাপারটাই খুব অদ্ভুত; রাতের ডিনার হয়ে গিয়েছিলো, সঞ্জীব আর বিনি ছিল একতলায় ওদের ঘরে, আগে যেটা ছিল মা আর অজিতদার বেডরুম। তিন্নি ছিল পাশের ছোট ঘরে, যেটা আগে অজিতদার স্টাডি ছিল। মা তিন্নিকে পড়াশোনা শেখাতেন , বিনি সেই কাজটা  বিয়ের পর থেকে করছে। তিন্নি ভালো করে কথা না বলতে পারলে কি হবে, মেয়ের শেখায় বেশ আগ্রহ।  বিশেষ করে ছবি দিয়ে যে সমস্ত জিনিস বোঝানো যায়, চটপট শিখে ফেলে তিন্নি। বিনির বিয়ের পর থেকে এই গত সাড়ে তিন বছরে ইংরেজি বর্ণমালা ভালোই রপ্ত করে ফেলেছে। যুক্তাক্ষর কম আছে এরকম বাংলাও মোটামুটি পড়তে পারে। খুব আগ্রহ নিয়ে নিজে নিজে ছবিও আঁকে মাঝে মাঝে ক্রেয়ন দিয়ে এলোপাথাড়ি লাইন টেনে। সঞ্জীবেরও আগ্রহ আছে তিন্নিকে লেখাপড়া শেখানোর ব্যাপারে; ও কোলকাতায় ওর বন্ধু-বান্ধবদের কাছে খোঁজ করবে বলেছে তিন্নিকে পাঠানো যায় এরকম স্কুল আছে কিনা সেটা জানার জন্যে।

কালকে রাতে  তিন্নি অজিতদার পুরোনো ঘরে বসে ছবি আঁকছিলো। ওই ঘরের পাশেই সিঁড়ি। বিনিদের ঘর থেকে সিঁড়িটা দেখা যায়। দোতলায় আছে বলতে ছাদ, আর বিনির পুরোনো ঘরটা; দরকার না পড়লে এখন আর কেউ  দোতলায় ওঠে না। সিঁড়ির আলোও জ্বলে না বললেই চলে। সঞ্জীব  খাটে বসে কলেজের মিড-টার্ম টেস্টের খাতা দেখছিলো, সেই প্রথম লক্ষ্য করে ব্যাপারটা।
সিঁড়ির আলোটা হঠাৎ করে একবার জ্বলে উঠলো । ভ্রূ কুঁচকে সঞ্জীব বিনিকে প্রশ্ন করে,
"বিনি, তিন্নি কি ওপরে যাচ্ছে ? একবার দেখবে ?"
বিনি সঞ্জীবের দৃষ্টি লক্ষ্য করে সিঁড়ির আলোটা দেখতে পায়; সে ঘর থেকে বেরিয়ে একবার উঁকি মারে পাশের ঘরে। তিন্নি একমনে ছবি আঁকছে। সঞ্জীবও বেরিয়ে এসেছিলো ওর সাথেই, সেও দেখে তিন্নিকে। সিঁড়ির আলোটা ঠিক এইসময়ে দপ  করে নিভে যায়।
-"বাল্বটা গেলো বোধহয়; দাঁড়াও পাল্টে আসি।  "
বিনি সবে বলতে যাবে, "থাক, এখন আর কে যাচ্ছে ওপরে, কাল সকালে পাল্টে দিও ", সিঁড়ির আলোটা আবার উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে ওঠে।
সঞ্জীবের ভ্রূ আবার প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করে ওর কপালে;  "কেটে যাওয়া বাল্ব আবার জ্বলে নাকি! দাঁড়াও তো দেখে আসি। "

সিঁড়ির আলোটার দুটো সুইচ, একটা নিচে, একটা উপরে, আর বাল্বটা ল্যান্ডিং-এ । দুটো সুইচ একসাথে অফ  বা অন করা থাকলে বাল্বটা জ্বলে। নিচের সুইচটা একবার দেখে নিয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় সঞ্জীব ল্যান্ডিং-এ। সঞ্জীব ল্যান্ডিং-এ পৌঁছনো মাত্র বাল্বটা নিভে যায়। বিনির মনে পরে, তাড়াহুড়োয় টর্চ নিয়ে যায়নি সঞ্জীব।
বিনি সঞ্জীবকে ডাকে, "আমি যাবো, টর্চ নিয়ে ?"
-"না, ঠিক আছে আসছি নিচে, টর্চটা নিয়ে আসাই  উচিত ছিল!"
বিনি মুখ থেকে  সাবধান কথাটা বেরোনোর আগেই , হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে সঞ্জীব!

আওয়াজে তিন্নি আঁকা ছেড়ে বেরিয়ে আসে।  বিনি তাড়াতাড়ি গিয়ে সঞ্জীবকে তোলে। সেরকম কিছু হয়নি, বেকায়দায় পড়ার জন্যে গোড়ালিতে হালকা মোচড় লেগেছে।
বরফ দেওয়া, বেঁধে রাখার পর্ব শেষ হলে বিনি জিজ্ঞাসা করে, "পড়ে গেলে কি করে ?"
-"জানি  না, কি পায়ে কিসব ঠেকে গেলো যেন! কিছু কি রেখেছ ল্যান্ডিং-এ ?"
-"না তো!" বিনি অবাক হয়ে উত্তর দিয়েছিল।

 সকালে  জেঠুর বাড়ি  ফোন করে বিতানকে আসতে বলে বিনি। তারপর  সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ গিয়ে একবার দেখে আসে, যথারীতি ল্যান্ডিং-এ কিছু নেই! দেখেশুনে চলতে পারে না লোকজন! শুধু একটাই জিনিস অবাক লাগে বিনির, সিঁড়ির সুইচটা অফ করা।  কাল সঞ্জীব যখন ওপরে উঠেছিল, সুইচটা অন  ছিল, যতদূর মনে পড়ে তার । দু-একবার জ্বালায়-নেভায় বাল্বটা, দিব্বি কাজ করছে!তারপর যখন বিনি রেডি হচ্ছে সঞ্জীবকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্যে, নতুন কেনা বাইকে চড়ে হাজির হয় বিতান বিনিদের বাড়ি।  বিতানের সাথে সঞ্জীবের খুব জমে।  বিতান বিনিকে  বলে, "বিনি  তুই কলেজ যা, চাকর মানুষ, ছুটি ছাটা নেই তোদের, আমি হলুম নিজেই নিজের মালিক, আমি ছুটি নিলে কারোর কিছু বলার নেই; আমি  নিয়ে যাচ্ছি ডাক্তারের কাছে জামাইকে !"
বিতানের পড়াশোনায় কোনোদিনই মাথা ছিল না, কোনোরকমে কলেজ টপকেছে। ইদানিং জেঠু একটা কাপড়ের দোকান করে দিয়েছেন, সেইটাই সামলায়। অনেকদিন ধরে পাড়ারই একটা মেয়ের সাথে প্রেম করে, এখন মাথায় ভূত ঢুকেছে বিয়ে করার।

আজ দুপুর থেকে যেন দুর্যোগ নেমে এসেছে পৃথিবীতে! বৃষ্টি, ঝড়! কলেজ থেকে ফিরতে গিয়ে পুরোপুরি ভিজে  গেছিলো বিনি, ছাতা নিয়ে যেতে ভুলেছিলো।  বাড়িতে  ঢুকে বারান্দায় সকালের শুকোতে দেওয়া তোয়ালে টেনে নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বসার ঘরে ঢোকে  সে, টি-টেবিলের ওপর ক্রেপ বাধা পা তুলে চেয়ারে আধ-শোয়া সঞ্জীব তার চুপচুপে ভিজে অবস্থার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে বলে  ওঠে,  "কাল যখন আমি পড়ে যাই, তিন্নি কি ছবি আঁকছিলো, তুমি জানো ?"
আচমকা এরকম একটা প্রশ্ন বিনিকে হতবাক করে দেয়।

টি টেবিলেই রাখা ছিল ক্রেয়ন ড্রয়িং টা, অগোছালো ছবি, পার্সেপশন বলে কিছু নেই ছবিটায়,  কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, একটা সিঁড়ি, আর সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে একটা সুইচে হাত রাখছে একটা মানুষ। মানুষটার মাথার জায়গায় একটা গোল্লা, হাত-পা গুলো কাঠি কাঠি, কিন্তু খুব যত্ন নিয়ে মানুষটার একটা জামা এঁকেছে তিন্নি; পাঞ্জাবি মতো; জামাতে আবার কিছু ফুল-টুলের ডিজাইনও আছে!
-"পরে এঁকেছে হয়তো! তুমি পড়ে গেছো শুনে-"
-"বিনি, জামার ডিজাইনটা দ্যাখ, মন দিয়ে। "
বিতানকে এতক্ষন লক্ষ্যই করেনি বিনি। বসার ঘর আর ডাইনিং-এর মধ্যের  দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে-"জামাইকে ডাক্তারখানা থেকে নিয়ে ফেরার পর তিন্নি নিজেই এই ছবিটা আমাকে এনে দেয়, আমিও তোর মতোই ভাবছিলাম, পরে এঁকেছে খেয়ালে; কিন্তু তিন্নি আঙ্গুল দিয়ে জামাটা বারবার দেখাতে থাকে আমায়; তখন আমি বুঝি ব্যাপারটা!"

বিনির কানের কাছে বিতানের গলার আওয়াজ আস্তে আস্তে পৌঁছনো বন্ধ করে দিতে থাকে, কারণ বিনিও  জামাটা চিনতে পেরেছে; মা নিজের হাতে এই এম্ব্রডাইরীটা করেছিলেন, কোনো একটা পুজোতে অজিতদাকে উপহার দিয়েছিলেন পাঞ্জাবিটা! তিন্নি সেই ডিজাইনটা নিখুঁত এঁকেছে। আর ছবির ওই গোল্লা-কাঠি মানুষটা অজিতদা!
তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ একটা ক্রেয়নে আঁকা  ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, আর ঠিক সেই সময়, পৃথিবী কাঁপিয়ে একটা বাজ পড়ে বাইরে!

পর্ব-৭

রিজু 

"পলা দিদিভাই, তোমাদের বন্ধুর সাথে ঠিক কি হয়েছিল বিশদভাবে বলতে পারবে আমাকে একটু  ?"

বাইরে সন্ধ্যে নামবে নামবে করছে, মায়ের বাড়ি ফেরার সময় প্রায় হয়ে এসেছে।   রিজু মনে মনে ভাবছিলো সৌম্যর ফোন থেকে মাকে একটা মেসেজ করে দেওয়া উচিত কিনা; দিপু একটা পেপারওয়েট হাতে নিয়ে সেটার দিকে একমনে তাকিয়ে আছে।  সৌম্যকে দেখলে বোঝা যাচ্ছে সে  রীতিমতো অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে। পলা  মনোযোগ আর উৎকণ্ঠা মেশানো একটা  দৃষ্টি নিয়ে স্থির হয়ে বসে আছে বই দাদুর দিকে তাকিয়ে। রিজু খেয়াল করে দেখলো, ওদের মধ্যে কেউ এতক্ষন কোনো কথা বলে নি।

বইদাদুর  কথায় একটু নড়েচড়ে বসে পলা; বন্ধুদের সবার মুখে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। নাজিয়ার ঘটনাটা নিয়ে ওরা কখনো কথা বলে না।
-"গত মাসে আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়; তার পরে নাজিয়ার বাবা আর মা নাজিয়াকে নিয়ে ওনাদের  গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। জায়গাটা আরশিপুর থেকে  অনেকটাই দূরে; দিল্লি রোড দিয়ে অনেকটা যেতে হয়, বাড়ির গাড়িতেই গিয়েছিলেন ওনারা, নাজিয়ার বাবা নিজেই ড্রাইভ করছিলেন..." পলা একটু থামে, "ঘটনাটা ঘটে ফেরার সময়। গ্রামের বাড়ি থেকে দুপুর করে  বেরিয়েছিলেন ওনারা, ভেবেছিলেন রাতের মধ্যে আরশিপুর পৌঁছে যাবেন। অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার কিছুক্ষণ পর গাড়ির চাকা পাংচার হয়, যার জন্যে কিছুটা দেরি হয়ে যায়। ওনারা ফের চলতে শুরু করার কিছুক্ষনের মধ্যেই এক্সিডেন্টটা ঘটে। উল্টো দিক  থেকে একটা লরি আসছিলো-"

পলার গলা ধরে আসে, ও চুপ করে যায়। দিপু বলতে শুরু করে এবার, "লরির ড্রাইভার বোধহয় ড্রাঙ্ক ছিল, নাজিয়াদের গাড়িটাকে ধাক্কা মারে, হেড অন কলিশন, পিষে দিতে পারতো ওদের, কিন্তু  নাজিয়ার বাবা শেষ মুহূর্তে রাস্তার বাঁদিকে গাড়ি নামিয়ে দেন .."
দিপুও চুপ করে যায় এবার। পলাই  ধরা গলায় বাকিটা বলে,
"নাজিয়ার বাবা স্পটেই মারা গিয়েছিলেন। নাজিয়াকে পুলিশ রেসকিউ করেছিল, ওর তেমন কিছু হয় নি,  কিন্তু ও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো।  ও গাড়ির পিছনের সীটে ছিল; সামান্য কেটে ছড়ে গেছে।  ফতিমা আন্টি, নাজিয়ার মাকে নাজিয়া পুলিশ স্টেশনে এসে দেখতে পায়।  আশ্চর্যজনক ভাবে আন্টিরও কিছু হয়নি, যদিও আন্টি সামনের সীটে ছিলেন-"
দিপু হঠাৎ পলার দিকে তাকিয়ে বলে, "না, নাজিয়া সামনের সীটে ছিল।  গাড়ি সারানোর পর ও জেদ  করে সামনের সীটে বসেছিল; আন্টি পিছনে বসেছিলেন।"
রিজু পলার মুখের বিরক্তিটা পরিষ্কার পড়তে পারে, "না, নাজিয়া পিছনে বসেছিল, আন্টি রাজি হননি ওকে সামনে বসতে দিতে, ও নিজে বলেছে আমাকে!"
-"ঘটনাটার পর আমি আমার মায়ের সাথে ওদের বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলাম, নাজিয়া ছিল না সেই সময়। আন্টি মাকে বলেছিলেন আন্টি পিছনের সীটে ছিলেন। আমার মনে আছে, কারণ আন্টি মাকে বলছিলেন ওনার জ্ঞান ফেরার পর উনি নাজিয়াকে খুঁজে না পেয়ে নিজেকে খুব দুষেছিলেন।  ওনার তো পুলিশ স্টেশনে জ্ঞান ফেরে।  সেখানে প্রথমে সবাই ওনাকে বলেছিল সামনে যারা ছিল তাদের বেঁচে থাকার চান্স নেই! আন্টি নিজেকে খুব দুষেছিলেন নাজিয়ার জেদের কাছে হার মেনে ওকে সামনে বসতে দেওয়ার জন্য! তারপরই প্রায় অক্ষত অবস্থায় নাজিয়া আসে পুলিশ স্টেশনে!

পলা কিছু একটা বলতে যাবে, সৌম্য ওকে থামায়, "আঃ, থাম তো তোরা! কি যায় আসে কে পিছনের সীটে ছিল সেটা নিয়ে? দুজনেরই ভয়াবহ ট্রমা গেছে, কেউ একজন ভুল বলছে, সিম্পল! দুজনেই বেঁচে ফিরেছে, এটাই কি যথেষ্ট নয়?"
বই দাদু এতক্ষন কোন কথা বলেননি, এবার বলে উঠলেন, "আসলে দাদু, ইট ইজ নট দ্যাট সিম্পল!"
রিজু এবং তার চার বন্ধু ঘরের একমাত্র পূর্ণবয়স্ক লোকটির দিকে তাকায়; বইদাদুর মুখ ভয়াবহ গম্ভীর। এক এক করে চার জনের উপরেই তাঁর চশমা দিয়ে ঢাকা ঘোলাটে চোখগুলো ঘুরে শেষে এসে থামে  রিজুর মুখের ওপর!
-"রিজু, তুমি বলছো শৃঙ্খলকরা তোমায় দেখা দেয়।  যখন দেখা দেয়, তখন ওরা এই যে নন্দিনীর কথা বলছো তোমরা, তাকে খোঁজে। ওরা যে এই নন্দিনীকেই খোঁজে তা তুমি জানলে কি করে ?"
রিজু অবাক হয়ে যায়, ওই সন্ন্যাসীরা যে নন্দিনীকে খুঁজছে, এটা ও জানে, নিশ্চিতভাবে জানে, কিন্তু কি করে জানে সেটা তো কখনো ভাবে নি!
-"আমি জানি ওরা নন্দিনীকেই খোঁজে, নিশ্চিত জানি, আমার মন বলে এটা", এইসব যা মনে আসছে আমতা আমতা করে বলতে বলতেই প্রানপনে একটা ভালো উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে চলে ভিতরে ভিতরে রিজু, তারপর ওর মনে পড়ে, "আর হ্যাঁ,  ওরা যে আগুনটা জ্বালায়, তার ধোঁয়াটা একদিন নন্দিনীর মুখের মতো আকার নিয়েছিল..."

বইদাদু ওর মুখের থেকে চোখ সরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে চোখ রাখেন; সন্ধ্যে নেমেই এসেছে, কিন্তু এখনো দিনের আলোর একটা খুব ফিকে রেশ আছে। ঘরে আলো জ্বালানো হয় নি এখনো; অন্ধকারটা বেশ জমাটিভাবে ঘাঁটি গেড়েছে তাই ঘরে।
সেই অন্ধকার ভেঙ্গে বইদাদুর গলা কানে আসে রিজুর, "রিজু দাদুভাই, শৃঙ্খলকরা ঠিক কি বলতে চায়, সেটা বুঝতে পারা বেশ শক্ত কিন্তু। আমি যদি পুরোটা ঠিক বুঝি, তবে শৃঙ্খলকরা হয়তো নন্দিনীকে খুঁজছে না রে দাদু, তোদের বান্ধবীকে খুঁজছে।  নাজিয়াকে। "

পর্ব-৮

বিনি 

 বাড়িটা এখন বেশ ভর্তি লাগে বিনির। রীচকের জন্মের কিছুদিন আগে থেকেই  ওর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি এসে থাকতে শুরু করেছিলেন যাতে বিনির একটু সুবিধা হয়; তা সুবিধা বিনির একটু নয়, অনেকই  হয়েছে।  কাজ কমে গেছে অনেক, রান্নাঘরের দিকে যেতেই হয় না ওকে ইদানিং, অন্য টুকি টাকি অনেক জিনিসের খেয়ালও রাখতে হয় না। ওর শ্বশুরমশাই তিন্নিকে পড়ানোর দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন সানন্দে। তবে বেশি ন্যাওটা হয়েছে তিন্নিটা শ্বাশুড়ির; সারাক্ষন উনি নারকেল নাড়ু আর আচার খাইয়ে তিন্নিকে নিজের বশে করে নিয়েছেন। শ্বাশুড়ির কথা অনুযায়ী কিছুদিন আগে মা আর অজিতদার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে একটা ছোটোখাটো অনুষ্ঠানও করেছে ওরা। রীচক তখন সবে দুই মাস।

সঞ্জীবের ব্যবহারটাই একটু অদ্ভুত লাগে।  আগে কলেজ থেকে ফিরে সন্ধ্যেবেলা বিতানের দোকানে গিয়ে গল্প-গুজব করতো, রাতে পাড়ার ক্লাবে ব্যাডমিন্টন খেলতে যেত। কিন্তু সেই যে পড়ে গিয়ে পায়ে লাগলো, তারপর থেকে সঞ্জীব কলেজ থেকে ফিরে জলখাবার নাকে মুখে গুঁজে অজিতদার পুরোনো ঘরে ঢোকে, আর বেরোয় না। সারাক্ষন অজিতদার রেখে যাওয়া বই আর খাতা-পত্র নিয়ে বসে থাকে।রাতে খেতে ডাকার জন্য বিনিকে প্রায় সাধ্য-সাধনা করতে হয়।  প্রশ্ন করলে জবাব আসে, "তোমার সৎ-বাবা খুব গুণী মানুষ ছিলেন, অনেক কিছু জানতেন; সেগুলোই নেড়ে ছেড়ে দেখি একটু।"

বিনিও দুয়েকবার নেড়ে ঘেটে দেখেছে অজিতদার বই-পত্র; অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন, অঙ্ক বিজ্ঞানের বই, কিছু খাতা-পত্র আছে, কিছু নোটস। বেশিক্ষন ওসব নিয়ে বসে থাকলে মায়ের কথা মনে খুব  পড়তো বিনির, ও হাল ছেড়ে দিতো। তিন্নির আঁকা অজিতদার ছবিটা সঞ্জীব খুব যত্ন করে অজিতদার ঘরে রেখে দিয়েছে। মাঝে মাঝে দেখেছে বিনি সেই দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে সঞ্জীব, চোখ বোজা। ঠিক যেন ধ্যান করছে। সত্যি বলতে, সঞ্জীবের এইসব ব্যবহার একটু মাত্রাতিরিক্ত লাগে বিনির। সেইদিন গোটা ঘটনাটা তারও বেশ অদ্ভুত লেগেছিলো, কিন্তু তার পর থেকে এত দিন হয়ে গেছে, বাড়ির আর কোনো আলোই আর  হঠাৎ করে  জ্বলে ওঠেনি, আর তিন্নি ওরকম আর কোনো ছবিও  আঁকেনি, সুতরাং বাচ্চার খেয়াল মনে করে বিনি ছেড়ে দিয়েছে ঘটনাটা নিয়ে ভাবা। আর বিতানের তো কথাই  আলাদা! মাসছয়েক আগে বিয়ে করেছে, তারপর জেঠিমার সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে বউকে নিয়ে আলাদা থাকে এই দুমাস মতো হলো।

বিনি এখনো কলেজ যাওয়া শুরু করেনি, ম্যাটারনিটি লীভ চলছে ওর।  নিজের খাটে বসে একটা বই পড়ছিলো সে, পাশে ছোট্ট রীচক ঘুমোচ্ছে।  তিন্নি ছাতে, বিনির শ্বাশুড়িমায়ের কাছে বসে আছে, উনি আচার  বানিয়ে রোদে শুকোতে দিচ্ছিলেন। বিনির শ্বশুরমশাই গিয়েছেন লাইব্রেরিতে, লাইব্রেরিয়ানের কাছে কি একটা খুব ইন্টারেষ্টিং বই-এর কথা শুনেছেন আগেরদিন! সঞ্জীব কলেজে। বইটায় রীতিমতো ডুবে গিয়েছিলো বিনি ।  সম্বিৎ ফিরলো মেঘের ডাকে।  জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে দেখে কখন ঝিরঝিরে বৃষ্টিও শুরু হয়েছে, সে খেয়াল করেনি। খাট থেকে নেমে তাড়াতাড়ি জানলা বন্ধ করতে গিয়ে বিনির খেয়াল হয় তিন্নি আর ওর শ্বাশুড়ির কথা; বৃষ্টি হবে আভাস  পাওয়ার আগেই তো নেমে আসা উচিত ছিল ওদের!
"মা" বলে একটা ডাক দেয় বিনি। উত্তর আসে না।
একটু গলা চড়িয়ে আবার ডাকে, "মা, তিন্নি?"
কড়কড় শব্দে একটা বাজ পড়ে কাছেই। বিনির বুকের মধ্যে একটা অমঙ্গলের আভাস; সে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এক দৌড়ে যায় সিঁড়ির কাছে।  নিচের ঘরে ওরা নেই, ও স্থির নিশ্চিত। রুদ্ধশ্বাস এক দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলার ঘর পেরিয়ে ছাতের দরজার মুখে দাঁড়ায় বিনি। সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা গুলিয়ে ওঠে তার। 

আকাশ কালো মেঘে ভর্তি, বৃষ্টিটাও  বেশ জোর হয়েছে এবার।  ছাদের মাঝখানে পাতা মাদুর, তার ওপরে ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো আর তেল মাখানো আমের মধ্যে ওর শ্বাশুড়ি পড়ে আছেন...এত দূর থেকেও বিনির বুঝতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না, ওই শরীরে প্রাণ নেই। ওনার মুখটা, বীভৎস ভাবে বেঁকে গেছে, চোখ বেরিয়ে এসেছে কোটর থেকে।  ওনার পাশে বসে আছে তিন্নি। সে বৃষ্টির মধ্যে মাথা নিচু করে শক্ত হয়ে বসে আছে।

তিন্নিকে তুলে নিচে নিয়ে এসে বিনি প্রায় যন্ত্রচালিতের মতো ফোনের বই হাতড়ে ফোন করেছিল কলেজ-এ, সঞ্জীবের ডিপার্টমেন্টে। তার পর লাইব্রেরিতে, তার পর বিতানের দোকানে। রীচকের কান্না, মেঘের ডাক আর বিনির নিজের বুকের মধ্যে হাপরের টান, কিছুই কানে আসছিলো না ওর।  সঞ্জীবই সবার আগে বাড়ি পৌঁছেছিল। উদ্ভ্রান্ত চেহারা, বৃষ্টিতে কাকভেজা, চোখদুটোতে একটা অদ্ভুত দিশেহারা ভাব।  বিনি যখন দরজা খুলছে, তখন বাড়িতে পা না দিয়ে, গ্রিল দরজার বাইরে থেকেই সঞ্জীব বলেছিলো, "এই শেষ বিনি, তিন্নি এবাড়িতে আর থাকবে না, যদি থাকে, আমি আমার ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে যাবো। "
বিনি প্রথমে কথাটার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেলো , তারপর স্বভাবসিদ্ধভাবে প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেলো সে।  আজ তিন্নিকে যখন ছাদ থেকে তুলে আনতে যায় সে তখনও গরম থাকা ওর শ্বাশুড়ির মৃতদেহের পাশ থেকে, তিন্নির চোখদুটোয় প্রায় জ্বলছিল। বারো বছরের একটা মেয়ের চোখে ওরকম একটা দৃষ্টি কল্পনাও করতে পারে না বিনি। ঠিক রাগের না, অনেকটা জেদের, আর সামান্য প্রতিহিংসার।

পর্ব-৯

রিজু 

"১৯৫৬ সালের শুরুর দিক। স্বাধীনতার পরে দশ বছরও হয় নি, ফ্রেঞ্চ কলোনি চন্দননগর সদ্য জুড়েছে বাংলার সাথে, ৫৪'র দুর্ভিক্ষের ছায়া তখনো পুরোপুরি কাটেনি, বাংলা তখনও ধুঁকছে খাদ্যাভাবে। আর্শিনগরে তখন তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা পড়াশুনো করে হ্যারিকেনের আলোয়, আমার জন্ম হতে তখন দুই বছর বাকি।"
বইদাদুর ঘরে একটা টিমটিমে বালব জ্বলছে মাত্র। রিজু আর তার তিন বন্ধু শুনছে ভবানীচরণ চট্যোপাধ্যায়ের গল্প। সম্পর্কে তিনি ছিলেন বইদাদুর কাকা।

"ভবানীচরণ যাচ্ছিলেন উমাশঙ্করের বাড়ির দিকে। উমাশঙ্কর ভবানীর বন্ধু, চাকরি সূত্রে কলকাতায়  থাকেন , অনেকদিন বাদে গ্রামে ফিরেছেন।  হ্যাঁ, তোমাদের মফস্বল শহর আরশিনগর তখনও দর্পনপুর গ্রাম।

"উমা কলকাতা থেকে ম্যাজিক শিখে এসেছে, পাড়াগাঁয়ের বন্ধুদের তাই নিমন্ত্রণ করেছে সন্ধ্যার জলখাবারে; আড্ডা, চা-জলখাবারের সাথে ম্যাজিক দেখাবে।  ভবানীর যাওয়ার সেরকম  ইচ্ছে ছিল না; মাসখানেক আগে মীনা, তার চারবছরের ছোট্ট মেয়ে, মারা গেছে। সবই ভগবানের ইচ্ছে হয়তো, নাহলে পৌষমাসে ওরকম আকাশ কালো করে বৃষ্টিই বা হবে কেন, আর মীনাই বা খেলতে গিয়ে ঐরকম ভাবে ভিজে ফিরবে কেন! তিনদিনের জ্বরে চলে গেছে মেয়েটা! ভবানীর স্ত্রীও মেয়ের মৃত্যুর পর বাপের বাড়ি চলে গিয়েছেন, আর ফেরেন নি।  ভবানীর তারপর থেকে আর বাইরে বেরোতেও  ইচ্ছা করে না, কারোর সাথে কথা বলা বা গল্প করা দূরে থাক।  নেহাত আজ বৌদি মাথার দিব্যি দিয়ে পাঠিয়েছেন উমাশংকরের বাড়ি, তাই ভবানী বেরিয়েছেন।

"উমাশঙ্করের স্ত্রী সাদর আপ্যায়ন করলেন ভবানীকে। ভবানী ছাড়াও অনন্ত, অসিত আর মাধব এসেছেন। সবাই বসলেন উমাশংকরের বসার ঘরে। জলখাবার পর্ব শেষ হলে, উমা একটা নাটকীয় ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো, স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললো, 'কৃষ্ণা, কই , নিয়ে এস মোমবাতিটা'!
"তারপর সেই নাটকীয় ভঙ্গি বজায় রেখে বন্ধুদের দিকে ফিরে উমা বললো, 'বুঝলে ভায়া, মানুষের মন বড়ো অদ্ভুত! মনের শক্তির বিন্দুমাত্র ধারণাও আমাদের নেই, তার প্রয়োগের কথা তো ভুলেই যাও! বড় কঠিন সাধনার পরে মনন শক্তির আভাসটুকু পাওয়া যায় মাত্র। আমি আজ তোমাদের সেই আভাসটুকুই দেব।'
"কৃষ্ণা, উমাশঙ্করের স্ত্রী ততক্ষনে একটা মোমবাতি নিয়ে এসেছেন বসার ঘরে।  হ্যারিকেন জ্বলছিল একটা, সেটাকে নিভিয়ে দেওয়া হলো; মোমবাতিটা রাখা হয়েছে একটা কাঠের চারপাই-এর ওপর। উমাশংকরের থেকে চারপাইটা প্রায় ফুটখানেক দূরত্বে রাখা।
"ভবানী দেখলেন উমা মোমবাতিটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঘরের কোনো একটা দেওয়ালে একটা বড়ো ঘড়ি আছে,  যেটার টিকটিক আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন ওঁরা, আর বাইরের ঝিঝির ডাক।  উমা কাউকে কোনো কথা বলতে বারণ করেছেন, তাই সবাই চুপ।
"কতক্ষন তা জানেন না ভবানী, কিন্তু আন্দাজ মিনিটদুয়েক। কেউ নিজের জায়গা থেকে নড়েনি, উমাশঙ্কর তো নয়ই।  অন্ধকার ঘরের মধ্যে দপ করে জ্বলে উঠলো মোমবাতিটা!

"নিজের বাড়ির দিকে ফিরছিলেন ভবানী। ভেল্কিটা ভালোই দেখিয়েছে উমা।  কোথা থেকে  শিখে এসেছে কে জানে! হঠাৎ করে এক পশলা ঠান্ডা হাওয়া একটু কাঁপিয়ে দিয়ে গেলো ভবানীকে; চাদরটা টেনে নিয়ে মুখার্জিদের ঠাকুরদালানের ভিতর দিয়ে একটা শর্ট -কাট নিলেন ভবানী; আর তখনি দেখলেন তাকে। ঠাকুরদালানের সামনে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে।  সেও দেখেছিলো ভবানীকে। 'বাবা' বলে চিৎকার করে এসে জড়িয়ে ধরলো ভবানীকে। মীনা!
"না, প্রেতের মতো ঠান্ডা নয়, রক্তমাংসেরই মেয়ে। কোলে তুলে মেয়েকে বাড়ি নিয়ে আসে ভবানী। মীনার কথা ছড়াতে দেরি হয়নি, গ্রামের বয়স্ক বৃদ্ধরা গ্রামে নানা রকম পুজো-অর্চনার ব্যবস্থা করেছিলেন সঙ্গে সঙ্গে, ভবানীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন মেয়েকে ত্যাগ করার; ও মেয়ে প্রেতলোক থেকে ফিরে এসেছে , ওকে নিজের কাছে রাখলে অমঙ্গল।  অনেকেই ভবানী এবং তার বাড়ির ছায়া মাড়ানো বন্ধ করে দিয়েছিলো। ভবানীচরণ কিছুতেই কান দেন নি। ভগবান যখন ফেরত দিয়েছেন মেয়েকে, এই অপ্রাকৃত ঘটনাকে তিনি  ভগবানের আশীর্বাদ হিসেবেই  মেনে নিয়েছিলেন। এই একটা মাস সে কোথায় ছিল, সে কথা মীনাকে জিজ্ঞাসা করলে সে মনে করতে পারেনি তার জ্বরের কথা, এমনকি সেদিনের বৃষ্টির কথাও। সে শুধু বলেছে সেদিন খেলতে গিয়ে দেরি হয়ে গিয়েছিলো, অন্ধকারে ভয় লাগছিলো, এমন সময় বাবাকে দেখতে পায়।
"এদিকে ভবানী ও তার পরিবারের ওপর গ্রামের লোকের চাপ ক্রমশঃ দুঃসহ হয়ে উঠছিলো। ভবানীর স্ত্রী ইতিমধ্যে ফিরে  এসেছিলেন মিনার ফেরার খবর পেয়ে,  স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে কলকাতায় চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন ভবানী, মীনাকে ফিরে পাওয়ার সেটা মাসখানেকও হয় নি ।

"ঠিক তখনই, মারা গেলো উমাশঙ্কর ।  দুপুরবেলা, নিজের ঘরে বসে, ২৭ বছরের যুবকের হার্টফেল করলো। কিন্তু সেটা ভয়াবহ নয়, ভয়াবহ ছিল উমাশংকরের মুখটা; ঠোঁটটা বেঁকে গেছে, চোখ বেরিয়ে  এসেছে কোটর থেকে। যেন ভীষণ ভয় পেয়েছে সে, অপ্রাকৃতিক ভয়। "

একটানা এতটা বলে থামলেন বইদাদু, তারপর রিজুর দিকে তাকালেন, "আর সেই রাতেই, রিজু দাদাভাই,  ভবানীচরণ প্রথমবার দেখলেন শৃঙ্খলকদের। "


পর্ব-১০

বিনি 

যতক্ষণ বাড়িতে থাকে না, অজিতদার ঘরটা তালাবন্ধ করে রাখে সঞ্জীব। আর যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, ওই ঘরেই থাকে আজকাল সে। ওপরের ঘরে সঞ্জীবের বাবা, নিচের বড় বেডরুমটা দুই বছরের রীচক আর বিনির। মা মারা যাওয়ার পরে বাবাকে একলা গ্রামের বাড়িতে থাকতে দিতে চায়নি সঞ্জীব।
বাবার সঙ্গে বেশ কিছুটা করে সময়ও কাটায় রোজ সে ইদানিং।  বরং বিনি আর সঞ্জীবের মধ্যেই একটা ব্যবধান তৈরি হয়েছে।

বিনি বুঝতে পারে, ব্যবধানটার নাম তিন্নি। দেড় বছর আগের সেই বিভীষিকাময় দিনটার পরে সঞ্জীব তিন্নিকে কিছুতেই বাড়িতে রাখতে রাজি হয় নি; মায়ের কাজের দিনটা অবধি অপেক্ষা করেছিল, ব্যাস। তার পরেরদিনই বিনিকে বলেছিল কলকাতায় একটা অনাথ আশ্রমে ওর এক বন্ধুর চেনাআছে,  আপাতত তিন্নিকে সেখানেই রেখে আসতে চায় ও।
অবাক হয়ে বিনি জিজ্ঞাসা করেছিল, "আজই?"
বিনির বিয়ের পর পাঁচ পাঁচটা বছর কেটে গেছে তখনো পর্যন্ত, সঞ্জীবকে কখনো মাথা গরম করতে দেখেনি বিনি। সেদিন বিনির সেই নির্দোষ প্রশ্নটায় যেন ফেটে পড়েছিল সঞ্জীব, "আর কে কে মরলে তোমার শিক্ষা হবে বিনি ? আমি? নাকি তোমার ছয়মাসের বাচ্চাটা ?"
বাড়িতে তখনও লোকজন আছে; বিতান, বিতানের বউ, বিনির জেঠুর মেয়ে দীপা। বিনির কান লাল হয়ে গিয়েছিল। খানিকক্ষন চুপ থেকে বিনি খুব শান্ত, কিন্তু দৃঢ় গলায় সঞ্জীবকে বলেছিল, "তোমার মায়ের হার্ট এট্যাক করেছিল, সঞ্জীব। ডাক্তার তাই বলেছে। তিন্নি ওনাকে খুন করেনি। "

তার পর বেরিয়ে গিয়েছিলো ঘর থেকে। ছাদে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল রেলিঙের ধারে। তিন্নিকে বোধহয় আর নিজের কাছে রাখা সম্ভব হবে না। ওর মন-প্রাণ না বলে চিৎকার করছিল বোনকে কোনো এক অচেনা অনাথ আশ্রমে অচেনা লোকের মাঝখানে ছেড়ে আসতে। কিন্তু তিন্নিকে যদি ও এখনও কাছে রাখতে চায়, তাহলে ওর নিজের সংসারটা ভেসে যাবে এবার। সেই সময়, হঠাৎ করে একটা নরম হাত ওর কোমরটা জড়িয়ে ধরেছিল, বিনি পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখেছিলো তিন্নি। নিমেষের মধ্যে ছাদে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে ছোট মেয়ের মতো কেঁদে ফেলেছিল বিনি, আর বুঝদার বড় দিদির মতো তিন্নি ওর রুক্ষ চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল আস্তে আস্তে, যেন বলতে চাইছে, ও সব বুঝতে পারছে, ও জানে, বিনির কিচ্ছু করার নেই।

রক্ষাকর্তা হয়ে এগিয়ে এসেছিলো বিতান, "বিনি, তিন্নি কটা দিন আমার কাছে থাক না হয় । তুই যখন হোক এসে দেখতে পারবি; এখন সঞ্জীবদা-"
 পরম কৃতজ্ঞ চোখে বিতানের দিকে তাকিয়ে বিনি বলেছিল, "মধুমিতার কোনো আপত্তি?"
-"না না, ও তো বাচ্চা ভালোবাসে!"

সেইদিনই বিকেলে,  তিন্নি  ওর ক্রেয়নের বাক্স, ছবির বই, আর আঁকার খাতা নিয়ে চলে যায় বিতানের বাড়ি ; আর সঞ্জীব আর বিনির মধ্যে তৈরি করে যায় এক আকাশচুম্বী দেওয়াল। মাঝে মাঝে বিনির মনে হতো দেওয়ালের একটু উচ্চতা কমেছে হয়তো, যেদিন রীচক প্রথম হাঁটতে শিখলো; যেদিন রীচক প্রথম আধো আধো স্বরে "মা" বলতে শিখলো, কিন্তু তার পরেই বইয়ের আলমারির কোনে গুঁজে রাখা 'ছবিতে ছেলেদের রামায়ণ' -এ চোখ পড়ে গেছে বিনির, আর দেওয়ালের উচ্চতা বেড়ে গেছে আরো কয়েক ফুট!

বরং বিনির শ্বশুরমশাই -এর সাথে বেশ গল্প হয় আজকাল বিনির। ভদ্রলোক বিনি আর সঞ্জীবের এই ছন্নছাড়া সংসারে একটা সেতু তৈরি করে রেখেছেন; উনি নাতি অন্তপ্রাণ, রীচককে তো উনি একাই সামলান, কিন্তু তারই মধ্যে,সঞ্জীবের প্রিয় রান্নাটা ঠিক আবদার করে বিনিকে দিয়ে করিয়ে নেন;
আবার বিনি যেদিন তিন্নির কাছে যাবে, সেদিন পাড়ার দোকান থেকে কিনে আনেন একটা বড়-সড় ক্যাডবেরি চকোলেট।

আজ সেইরকম একটা দিন। রবিবার, বিনির কলেজ নেই। দুপুরে খাওয়ার পর বিনি বাধাকপির পায়েস বানিয়েছে, তিন্নি ভালোবাসে।  বিকেল একটু গড়াতে পায়েস আর চকোলেট নিয়ে বিনি এসে পৌঁছয় বিতানের বাড়ি। ডোরবেল বাজাতে মধুমিতা এসে দরজা খোলে।  তারপর খুব অবাক হয়ে যায় বিনিকে দেখে, "বিনিদি, তুমি? বিতানের সাথে দেখা হয় নি তোমার ?"
-"না তো।  কোথায় বিতান ?"
-"তোমার বাড়ির দিকেই তো গেলো। তিন্নি আজ দুপুরে তোমার বাড়ির একটা ছবি এঁকে খালি বিতানকে দেখাচ্ছিল। এদিকে তুমি আগের রবিবার আসোনি, আজ আসবে কিনা জানাওনি, মেয়েটা রবিবারগুলো তোমার পথ চেয়েই বসে থাকে, তো বিতান ভাবলো নিয়ে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।    ইস একটা ফোন করে যাওয়া উচিত ছিল বিতানের!"
মধুমিতার ডাকা সত্ত্বেও বিনি আর বসে না, সঞ্জীব বাড়িতেই আছে, কে জানে কি সিন ক্রিয়েট করে আবার, ভেবে ফেরত আসে নিজের বাড়ির দিকে।

বাড়িতে ঢোকার মুখে চোখ পড়ে দরজার সামনে রাখা বিতানের বাইকটার ওপর। হালকা সন্ধ্যে নেমেছে; কিন্তু বাড়ির আলো জ্বালায়নি কেউ এখনো। বাবা তো মনে হয় বেড়াতে গেছেন নাতিকে নিয়ে, সঞ্জীব থাকলেও অজিতদার ঘরে বসে ধ্যান করছে, ওর এসব খেয়াল থাকে না, কিন্তু বিতানটা কি করছে! মনে মনে ভাবতে ভাবতে বারান্দায় ওঠে বিনি। কান্নার আওয়াজটা  তখনি কানে আসে ওর। বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে ১৪ বছরের তিন্নি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
-"তিন্নি, কাঁদছিস কেন, বিতান কোথায় ?" অজানা এক আশঙ্কা বুকে নিয়ে  কাঁপা গলায় নিয়ে প্রশ্নটা করে বিনি।
তিন্নি আঙ্গুল বাড়িয়ে দেয় বারান্দায় খোলা এক পাটি চটির দিকে। বিতানের চটি! বিস্ফারিত চোখে "বিতান" বলে চিৎকার করে বিনি। বাড়ির সদর দরজা ঠেলে বাড়ির ভিতর খুঁজে আসে একবার, চিৎকারে সঞ্জীব বেরিয়ে আসে অজিতদার ঘর থেকে।
বিতানের বাইক পড়ে আছে, খোলা চটিও, বিতান কোথাও নেই।


পর্ব-১১

রিজু 

"উমার শেষ যাত্রায় সঙ্গী ছিলেন না ভবানীচরণ। গ্রামের লোক তাঁকে একঘরে করে রেখেছে; দূর থেকেই ছোটবেলার বন্ধুকে শেষ বিদায় জানাতে হয়েছিল ওনাকে। ওনার নিজেরও এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন কাছে এগিয়ে এসেছে। সব মিলিয়ে নাড়িছেঁড়ার কষ্ট টের পাচ্ছিলেন ভবানী বুকের ভিতর।
কি করবেন বুঝতে না পেরে গ্রামের রাস্তায় এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন উদ্ভ্রান্তের মতো। মাঘমাসের শেষ। উমাকে নিয়ে গ্রামের লোক শ্মশানের দিকে যাত্রা করেছিল দুপুর থাকতে থাকতে। সন্ধ্যে নামার বেশ খানিকক্ষণ পরে ভবানী অবশেষে বাড়ির রাস্তা ধরলেন।"

বইদাদু একটু থামলেন। বাড়ির ভিতর থেকে চা নিয়ে এসেছে ওনার চাকর। পলা, রিজুদের জন্য শরবত।  চায়ে একটা চুমুক দিয়ে আবার শুরু করলেন গল্প।

"ভবানীর বাবা, আমার ঠাকুরদাদা গত হয়েছেন স্বাধীনতার আগেই, আর আমার ঠাকুরমা তার পরপরই। দুইভাইয়ের সংসার। মীনা ফিরে আসার আগে অবধি হাঁড়িও এক ছিল।  কিন্তু মীনা ফিরে আসার পর, আমার মা, ভবানীর বৌদি, সম্পর্ক ছিন্ন করেন ভবানীর সঙ্গে। ভবানী এবং তাঁর পরিবারের জায়গা হয় বার বাড়িতে। "
-"বার বাড়ি?"
দিপু থামায় বইদাদুকে। বিরক্তির সুরে পলা বলে, "এই জন্যে একটু বই-টই পড়তে হয়, জানিস তো!বইদাদুদের বাড়িটা যে একটা পুরোনো আমলের বাড়ি যে সেটা তো দেখতেই পাচ্ছিস।এই ধরণের বাড়িতে  আগেকার দিনে অনেকগুলো ভাগ থাকতো।  খুব সংক্ষেপে বললে, ভিতরের বাড়ি, যেখানে মেয়েরা থাকতেন সেটা অন্দর, বাইরের পোরশনটা, যেখানে সাধাণতঃ কাজ কর্ম হতো, সেটা বার-বাড়ি। বুঝলি ? এবার চুপ করে বইদাদুকে গল্পটা বলতে দে। "

বইদাদু একটু  হেসে বলেন, "হ্যাঁ, পলা দিদিভাইয়ের ডেফিনিশনটা পুরো ঠিক না হলেও, আপাতত কাজ চলে যাবে। যাই হোক, উমাশংকরের সেই ট্রাজিক মৃত্যুর দিনে, ভবানীচরণ বাড়ি ফিরতে রাত করেছিলেন। আর আমাদের বার-বাড়িটা, এখন যেটা একটা ধ্বংসস্তূপ মাত্র, বেশ অন্দরমহল থেকে খানিকটা দূরেই। চিৎকার করলে শোনা যেত না।  সেই জন্যেই বোধহয় ব্যাপারটা.."

একটু চুপ করে গিয়ে আবার শুরু করেন বইদাদু , "ভবানীচরণেরই লেখা এই বই, "দর্পনপুরের অজানা ইতিহাস" ; আমি এই বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ীই বলছি। ভবানীচরণ বার-বাড়িতে ঢুকে চমকে উঠেছিলেন। আমাদের বার-বাড়িটা ছিল একতলা, অনেকটা ইংরেজি ক্যাপিটাল ই-এর মতো দেখতে, খালি ই-এর  মাঝের অংশটা নেই।  মাঝখানে ঘরগুলো লম্বা করে সারি দেওয়া, আর দুদিকে হাতার মতো করে আরও দুটো বড়ো ঘর , মাঝখানে ফাঁকা জায়গাটায় শানবাঁধানো উঠোন । সেই উঠোনের উপর দাঁড়িয়ে আছেন ছয়জন সন্ন্যাসী, ।  সুঠাম দেহ, চমৎকার গড়ন। উর্ধাঙ্গে রুদ্রাক্ষের মালা। পরনে গেরুয়া  ধুতি। উঠোনের ঠিক মাঝখানটায় একটা নিটোল বৃত্ত বানিয়ে তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন। বৃত্তের মাঝখানে জ্বলছে একটা অগ্নিকুন্ড। তার ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে উঠেছে উপর দিকে!

" আর উঠোনের এককোনে পড়ে আছেন ভবানীর স্ত্রী, নিথর দেহ, মুখটা ঈষৎ বেঁকে আছে।কাছে না গিয়েও ভবানীর বুঝতে কোনো অসুবিধা হলো না,  ওই দেহে প্রাণ নেই।  ভবানীর মাথাটা টলে উঠলো, পড়ে যেতে যেতে হঠাৎ মনে হলো তাঁর, মেয়ের কথা! মীনা কোথায়! এদিকে ওদিকে চোখ উঠোনের ওপাশের বুলিয়ে বারান্দার থামের আড়ালে মেয়ের হাতটা যেন দেখতে পেলেন তিনি। স্থানকাল ভুলে অস্ফূটে ডেকে ফেললেন একবার, 'মীনা!'

"ছয়জন সন্ন্যাসী নিমেষের মধ্যে ফিরে তাকালো ভবানীর দিকে। রক্তবর্ণ চোখ তাদের। ভবানীর তখন পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছে। কিন্তু চোখ বন্ধ হওয়ার আগেই তিনি দেখতে পেলেন, ছয়জন সন্ন্যাসী একসাথে তাঁর দিকেই তাকিয়ে বলে উঠেছেন, "সূত্রধার!"

"গুরুগম্ভীর সে গলার আওয়াজ, কিন্তু শুনে মনে হয় না, ইহজগতের! মাথার চুল থেকে পায়ের নখ শিউরে ওঠে সেই আওয়াজ শুনলে। ভবানী মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখলেন, ছয়জনের একজন বৃত্ত ভেঙে এগিয়ে আসছেন তাঁর দিকে। ভবানীর অন্তরাত্মা বলে উঠলো, 'পালাও!', কিন্তু পা দুটোকে কেউ যেন আঠা দিয়ে আটকে রেখেছে মাটিতে। এদিকে, সন্ন্যাসী এগিয়েই আসছেন ওনার দিকে। হাতে হাত ছোঁয়ার দূরত্বে এসে থেমে গেলেন তিনি। তার পর আবার সেই রক্তজল করা আওয়াজে বলে উঠলেন,
-'সূত্রধার, আমরা শৃঙ্খলক। প্রকৃতির শৃঙ্খলাকে রক্ষা করাই আমাদের কাজ; শৃঙ্খলা যারা ভাঙে তাদের আমরা শাস্তি দিই ; শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে যারা বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাদেরকেও আমরা মুছে ফেলি।'

ভবানীর মাথায় শব্দ গুলো গিয়ে বিঁধছিলো এক এক করে; কিন্তু তিনি তাদের কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়ার আগেই, সন্ন্যাসী আবার বলে উঠলেন, 'তুমি সূত্রধার। তোমার দায়িত্ব শৃঙ্খলকদের সাহায্য করা; এই লোকের  সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের জন্য কেবলমাত্র তুমিই আমাদের ভরসা। তোমার দায়িত্ব আমাদের সহায়তা করা, যাতে আমরা অসঙ্গতি দূর করে প্রকৃতিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারি। আমাদের সাহায্য করো সূত্রধার!'

ভবানীর ঠোঁট দিয়ে প্রায় না শোনার মতো আওয়াজ বেরোলো একটা, "অসঙ্গতি!"

সন্ন্যাসী আঙ্গুল বাড়িয়ে দিলেন উঠোনের থামের দিকে, যার আড়ালে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোট্ট মীনা!ভবানীর গোটা শরীর কেঁপে উঠলো; মীনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে এই সন্ন্যাসীরা! কিন্তু কোন পরলোকে!
সন্ন্যাসীর বলা শেষ হয়নি তখনও , 'সূত্রধার, অসঙ্গতি দূর না করতে পারার কারণে দুটি মৃত্যু ঘটে গেছে ইতিমধ্যে এই লোকে ! তুমি আমাদের সাহায্য না করলে, আরও অঘটন ঘটতে থাকবে, একে একে মৃতদেহের সংখ্যা বাড়বে, অঘটনের পর অঘটন ঘনাবে; ছারখার হয়ে যাবে এই জগৎ!'

ভবানী বুঝতে পারেন, এই সন্ন্যাসীরা, শৃঙ্খলকরা, তাঁর কোনো ক্ষতি করবে না যদি তিনি এঁদের কথা শোনেন, কিন্তু মীনা? দ্বিধাবিভক্ত মনে ভবানী একবার ভাবেন কি করা উচিত! এক মাসও হয় নি মেয়েটাকে ফিরে পেয়েছেন ভবানী! তারপরই  ভবানীর চোখ পড়ে উঠোনের একপ্রান্তে পড়ে থাকা তাঁর স্ত্রীর মৃত শরীরে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে উমাশঙ্করের বীভৎস মৃতদেহটা !
মাথা নিচু করে,  মৃদুস্বরে ভবানী বলেন, 'কি সাহায্য চাই, বলুন।'


পর্ব-১২

বিনি

মধুমিতার মুখের দিকে বহুদিন তাকাতে পারেনি বিনি। মেয়েটার সবে বছর দুয়েক হয়েছিল বিয়ের। বিতানটা তখনই...
সেদিনকার পর বিতানকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। থানা-পুলিশ করেও কোনো লাভ হয়নি; শুধু থানায় যাতায়াতই সার। তিন্নিকে বহুবার বহুভাবে জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করা হয়েছে, তিন্নি একটাও কথা বলেনি। আঙ্গুল দিয়ে দরজার দিকে দেখিয়ে গেছে শুধু।
তিন্নি তারপর থেকে এবাড়িতেই আছে।  সেটাও একটা অদ্ভুত ব্যাপার! বিতান যেদিন হারিয়ে যায়, সেদিন একপ্রস্থ থানা পুলিশ আর আত্মীয়-স্বজন সামলে উঠতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল, তিন্নি রীচকের পাশেই বিনির খাটে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মধুমিতাকে নিয়ে ওর বাবা নিজেদের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। গম্ভীর মুখে বসার ঘরে বসেছিলেন সঞ্জীব আর বিনির শ্বশুরমশাই। একটু ভয়ে ভয়েই বিনি ওঘরে ঢোকে। বাবা আর ছেলে খুব নিচু গলায় কিছু একটা নিয়ে কথা বলছিলেন, বিনিকে দেখে চুপ করে যান। বিনি সঞ্জীবের দিকে তাকিয়ে বলে, "সঞ্জীব, তিন্নিকে..."
তিন্নিকে এবাড়িতে রাখা নিয়ে সেই মুহূর্তে বিনির মনেও একাধিক সংশয় জন্ম নিয়েছে; সে ঠিক করেই এসেছিল, সঞ্জীব যা বলে, সে মেনে নেবে।
কিন্তু বিনিকে মাঝপথে কেটে, আর কিছুটা অবাক করে দিয়েই সঞ্জীব বলে ওঠে, "এখানেই থাকুক তিন্নি।"
ঘরের মধ্যে একটা অদ্ভুত নীরবতা। সঞ্জীব কিছু একটা বলতে গিয়েও বলে না, বিনির দিকে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। ছেলে বেরিয়ে যাওয়ার পর, সঞ্জীবের বাবা মৃদু হাসেন বিনির দিকে তাকিয়ে, তার পর ওর কাছে এসে মাথায় হাত রেখে বলেন, "এত চিন্তা করিস না, মা। এই সব যা হচ্ছে, ভুলেও ভাবিস না এসব তিন্নির দোষ। কিছু হবে না। আমরা আছি!"

সত্যিই তারপর কিছু হয় নি, প্রায় বছর পাঁচেক নির্বিবাদ জীবন কেটেছে বিনি আর তার ছোট সংসারের বাকি মানুষ গুলোর। সঞ্জীব এখনো অজিতদার ঘরেই দিনের বেশিরভাগ সময় কাটায়, কিন্তু বিনির এখন সেটা অভ্যাস হয়ে গেছে,  সে ভীষণ ব্যস্ত কলেজ আর বাকি মানুষগুলোকে নিয়ে। বিনির শ্বশুরমশাই বাগানে রীতিমত সব্জি খেত তৈরি করেছেন, আর বসার ঘরটাকে একটা মিনি-লাইব্রেরি বানিয়ে তুলেছেন। রীচক এখন সাত বছরের, তিন্নি আঠেরো পেরিয়েছে; কিন্তু যতক্ষণ রীচক বাড়ি থাকে, দুজনে একসাথেই থাকে, ভীষণ বন্ধু দুজনে। রীচক তিন্নিকে নাম ধরে ডাকে, বিনি বারবার বলেও ছেলের এই অভ্যাসটা কাটাতে পারে নি। এমনকি রীচকের অন্য বন্ধুরাও তিন্নিকে নাম ধরেই ডাকে, তিন্নির সাথে খেলা-ধুলোও করে। হয়ত এই ছেলে-মেয়েগুলো আর তিন্নির মনের বয়স একই রকম, তাই বোধহয় এরা এত ভালো বন্ধু হতে পেরেছে তিন্নির, ভাবে বিনি!

পাঁচটা বছর মন্দ কাটেনি বিনির অস্থির জীবনটা। বিতান হারিয়ে যাওয়ার পরে বাপের বাড়ির সাথে তার শেষ যোগাযোগটুকুও চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু সে ভালোই ছিল; মাঝে মাঝে অমঙ্গল চিন্তা যে  তার হতো না তা নয়, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে তার জীবন মোটামুটি গুছিয়ে গিয়েছিলো।

এমনি সময়, হঠাৎ করে একদিন হারিয়ে গেলো তিন্নি

বিকেলবেলা, রীচকের স্কুলের বন্ধুরা এসেছিল স্কুল ছুটির পরে।  বিনি ছিল কলেজে, সঞ্জীবের সেটা অফ-ডে, সে বাড়িতেই ছিল।  সঞ্জীবের বাবা বাড়িতে ছিলেন না, দুপুর থেকে সন্ধ্যে উনি লাইব্রেরিতে কাটান।  রীচক আর তার বন্ধুদের থেকে শুনেছে বিনি, ওরা লুকোচুরি খেলছিল। রীচকের পালা ছিল সেটা বন্ধুদের খোঁজার।  সে ছিল বসার ঘরে, বই-এর আলমারির দিকে মুখ করে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে এক থেকে একশো গুনছিল।  রীচকের এক বন্ধু দেখেছিলো তিন্নিকে সঞ্জীবের ঘরে, মানে অজিতদার পুরোনো ঘরে ঢুকতে। সেই শেষ। তারপর আর কেউ খুঁজে পায়নি তিন্নিকে।
সঞ্জীবকে জিজ্ঞাসা করলে সে  পায়ের নখের  দিকে তাকিয়ে বলেছে, "ও ঢুকেছিলো এঘরে, কিন্তু বেরিয়ে গিয়েছিলো তারপর।"
আর সবাই সঞ্জীবকে বিশ্বাস করলেও, বিনি করেনি। প্রত্যেকে, এমনকি পুলিশও ভেবেছিল, মেয়েটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো, তার পর কোথাও চলে গেছে। কিন্তু একটা মানুষের সাথে বারো বছর একই বাড়িতে থাকলে এইটুকু জানা যায়, সে মিথ্যে কথা বলার সময় পায়ের নখের দিকে তাকায়। বিনি বহুবার জিজ্ঞাসা করেছে সঞ্জীবকে, সঞ্জীব প্রথমে মিথ্যা বলার চেষ্টা করেছে, পরে চুপ থেকেছে। শেষ পর্যন্ত বলেছে, "সব প্রশ্নের উত্তর জানতে নেই বিনি। শুধু এইটুকু জানো, এবার আমরা নিজেদের সংসারটা শান্তিতে করতে পারবো। তিন্নি এই জগতের কেউ ছিল না  বিনি, তিন্নি আমাদের কেউ ছিল না কোনোদিন!"

অসহ্য রাগে ফেটে পড়েছিল বিনি, চিৎকার করে বলেছিল, "তিন্নি আমার বোন ছিল, সঞ্জীব। সে হারিয়ে গেছে। তুমি যদি কিছু জানো তার ব্যাপারে, তোমার দায়িত্ব সেটা বলা, নাহলে-" বিনি একটুখানি থেমে গিয়েছিল কথাটা শেষ করার আগে। তারপর গলা নামিয়ে, শক্ত গলায় বলেছিলো, "নাহলে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না আর।"

সেইদিন রাতেই সঞ্জীব বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। বিনির শ্বশুরমশাইও, ছেলের সাথে চলে গিয়েছিলেন। বিনি আটকাতে চেয়েছিলো ওনাকে, কিন্তু কিছু বলতে পারেনি। প্রথমের কয়েকটা মাস সঞ্জীবের সাথে কোনো যোগাযোগ ছিল না বিনির, ওর শ্বশুরমশাই-ই যোগাযোগ রাখতেন। সেই সময়ই দিল্লিতে একটা উনিভারসিটিতে চাকরি নিয়ে সঞ্জীব চলে যায় বাংলার বাইরে।

তারপর দেখতে দেখতে দশটা বছর কেটেছে। বিনির শ্বশুরমশাই আর নেই, কালের নিয়মেই স্বাভাবিক ভাবে মৃত্যু হয়েছে তাঁর কয়েক বছর আগে। বিনি বা সঞ্জীব, কেউই ফরমালি ডিভোর্স নেয় নি এখনো।  সঞ্জীব বছরে দুবার করে এসে ছেলের সাথে দেখা করে যায়। রীচক মায়ের কাছেই থাকে, সে এখন ষোলো। তিন্নি, বিতান এদের মুখগুলো বড় আবছা লাগে আজকাল আজকের পঁয়তাল্লিশের অভিজ্ঞ কলেজ শিক্ষিকা সর্বানীর। তবু যেসবদিনগুলো  ঝড়-বৃষ্টি হয়; হঠাৎ করে তিন্নির কথা মনে পড়ে যায়, আর বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।

কলেজ থেকে ফিরে, চায়ের জল চাপিয়েছিলেন সর্বানী। রীচক বাড়ি ছিল না, পড়তে গেছে ধরে নিয়েছিলেন তিনি, আজ ফিজিক্স টিউশন থাকে ছেলেটার। চায়ের জলটা সবে ফুটতে শুরু করেছে, মোবাইল বেজে উঠলো তাঁর। গ্যাসটা কমিয়ে বসারঘরে এসে ফোনটা ধরলেন সর্বানী। সৌম্যদীপের নম্বর থেকে ফোন, সৌম্য রীচকের বন্ধু। ওপার থেকে একটা অস্থির গলা বলে উঠলো,
-"মা, রিজু বলছি। আমরা চারজন আছি, আমি পলা, দিপু আর সৌম্য। আমরা  এক্ষুনি বাড়ি আসছি, তুমি বাবার সাথে যোগাযোগ করো; ভীষণ দরকার!"

পর্ব-১৩

রিজু 

রিজুর মাথার মধ্যে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। ওর বাকি তিন বন্ধুর অবস্থাও সেইরকমই।বইদাদুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে অরুণাভদার বাড়ির দিকে যাচ্ছিল ওরা চারজন; সঙ্গে সাইকেল থাকা সত্বেও হাঁটছিল ওরা, যাতে কথা বলতে সুবিধা হয়। অবশ্য বইদাদুর বাড়ি থেকে বেরোনোর পর প্রায় তিন-চার মিনিট কেটে গেছে, কিন্তু ওরা কেউ কোনো কথা বলে উঠতে পারেনি এখনো।
চারপাশের অন্ধকারটা বেশ জাঁকিয়ে এসেছে, কেমন একটা থম মেরে আছে প্রকৃতি; ঝড় হবে হয়তো। ওদের মধ্যেও একটা নীরবতা গুমোট বেঁধে উঠেছে, ওরা প্রত্যেকেই ভাবছে এক্ষুনি যা শুনে এসেছে, তার কতটা বিশ্বাস করা উচিত; আর যদি বিশ্বাস করেও, কি কর্তব্য ওদের এই মুহূর্তে ?

দিপু , কিছুটা জোর করেই, যেন কেবলমাত্র এই অসহ্য নীরবতাটাকে কাটাবার জন্যই বলে ওঠে, "মানেটা কি দাঁড়ালো তাহলে ? রিজু সূত্রধার? আর নাজিয়া অসঙ্গতি? রিজুকে ওই সন্ন্যাসীরা বলবে-"
কথাটা শেষ করতে পারে না দিপু ।
সৌম্য না বলার মতো করে মাথাটাকে দুদিকে নাড়ায়, যেন ও যদি নাকচ করে দেয়, তাহলে একটু আগে বইদাদুর থেকে শুনে আসা গল্পটার কোনো ভিত্তিই  থাকবে না, তারপর বলে, "দ্যাখ ভাই, গল্প শুনতে বলেছিল পলা, শুনে এসেছি। কিন্তু মনে রাখ ওটা গল্পই। এসবের কোন মানে নেই, নাজিয়ার ব্যাপারটা জাস্ট একটা ভুল বোঝাবুঝি। আর আমি তো রিজুর হ্যালুসিনেশনের একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছি আগেই! আর রিজু, বইদাদু তো বললেনই তোর দাদু এই গল্পটা জানতেন, তুই ওনার থেকে শুনেছিস হয়তো ছোটবেলায়, সেটা অবচেতনে থেকে  গেছে। এসব গল্প বিশ্বাস করার মানে হয় না ! আমি অন্তত করি  না..... "
সৌম্যকে শেষ করতে না দিয়েই রিজু বলে ওঠে, "আমি বিশ্বাস করি। আমি এক মাস ধরে একই
জিনিস রোজ দেখে যাচ্ছি, এটা হ্যালুসিনেশন নয়, আমি জানি।"
সৌম্য চুপ করে যায়।  দিপু বলে, "কি করবি তাহলে, রিজু ? কিছু তো একটা করতে হবে...নাহলে-"
রিজু উত্তর দেয়, "জানি না! নাজিয়ার সাথে একবার কথা বলতে পারলে ভালো হতো, হয়তো।"
দিপু আবার বলে, "কিন্তু একটা জিনিস ঠিক বুঝছি না। ভবানীর সাথে তো শৃঙ্খলকরা কথা বলেছিলেন, তোর সাথে বলছেন না কেন?"
-"হয়তো আমি সুযোগ দিই নি কথা বলার; একটা জিনিস ভেবে দ্যাখ, ভবানী মীনার নাম নেওয়ার পর শৃঙ্খলকরা ওনার সাথে কথা বলতে পেরেছিলেন, তার আগে নয়।  আমি যেদিন দ্বিতীয়বার দেখি শৃঙ্খলকদের, আমি ধোঁয়ার মধ্যে নন্দিনীর মুখটা দেখতে পেয়েছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমার মুখ দিয়ে 'নন্দিনী' নামটা বেরিয়ে যায়। ঠিক তখনি, ওঁরা সবাই আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। কিন্তু আমি ভয় পেয়ে ঘরে ঢুকে গিয়েছিলাম। সেটা যদি না করতাম, তাহলে-" একটুখানি দম নেয় রিজু, "কিন্তু সেটাও তো একটা বড় প্রশ্ন, নাজিয়া যদি অসঙ্গতি হয়, নন্দিনী আসছে কেন এর মধ্যে? ঠিক কি করতে হবে আমাকে?"

রিজুর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়; ভবানীচরণের কি করণীয়, সেই প্রশ্নের উত্তর শৃঙ্খলকরা তাঁকে দিয়েছিলেন; আর তার সঙ্গে জানিয়েছিলেন বাকি দুটি মৃত্যুর কারণ। উমাশঙ্কর প্রকৃতির নিয়ম ভেঙ্গেছিলেন; এমন নিয়ম, যার ফলস্বরূপ মৃত্যুর পরেও ফিরে এসেছিল ভবানীচরণের মেয়ে মীনা। তাই শৃঙ্খল ভাঙার শাস্তি পেতে হয়েছিল উমাশঙ্করকে। শৃঙ্খলকদের দুটি কাজ, যে শৃঙ্খল ভাঙে তাকে শাস্তি দেওয়া, আর অসঙ্গতি দূর করে প্রকৃতির রাজ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, অর্থাৎ মীনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া, যেখান থেকে সে এসেছিল। এই কাজে যে বাধা দেবে, তারও পরিণতি মৃত্যু। ভবানীর স্ত্রী বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মীনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে, সুতরাং তাঁর মৃত্যুও ছিল অবধারিত।
সন্ন্যাসী বলেছিলেন ভবানীকে, শৃঙ্খলকদের কেবলমাত্র তখনি দেখতে পাওয়া যায়, যখন তাঁরা নিজে থেকে দেখা দেন, কিন্তু কিছু মানুষ আছেন, যারা তাঁদের এমনিই দেখতে পান, বা তাঁদের  সাথে কথা বলতে পারেন। আর এঁদেরকেই  'সূত্রধার' বলে উল্লেখ করেছিলেন শৃঙ্খলকরা । ভবানীচরণ ছিলেন এইরকম একজন। একইসাথে শৃঙ্খলকরা এটাও জানিয়েছিলেন, সূত্রধারের কর্তব্য অসঙ্গতি দূর করায় শৃঙ্খলকদের সাহায্য করা।
-"অর্থাৎ?" প্রশ্ন করেছিলেন ভবানী, মাঘমাসের শীতে নিজের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে।
-"আমাদের শক্তি অনেক, সূত্রধার, কিন্তু আমরা নিয়মের দাস। আর শৃঙ্খলা রক্ষা করে নিয়মই। নিয়ম আমাদের বলে, অসঙ্গতি যদি চেতনাসম্পন্ন হয়, তবে তার অনিচ্ছায় তাকে আমরা তার নিজ লোকে ফিরিয়ে  নিয়ে যেতে অপারগ। এমনকি তার অনিচ্ছায় আমরা তার সাথে কথা বলতেও অসক্ষম। কিন্তু তুমি পারো। বর্তমান ঘটনায় মীনা, তোমার মেয়ে হলো অসঙ্গতি। তাকে তার নিজলোকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াটা নিতান্ত প্রয়োজন।  তোমাকে মীনাকে বোঝাতে হবে, যাতে সে রাজি হয় আমাদের সাথে ফিরে যেতে।"

মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল ভবানীর। চার বছরের মেয়েকে কিভাবে বোঝাবেন তিনি একথা? ভুলিয়ে ভালিয়ে, "তুমি যাও ঠাকুরদের সাথে, আমি এক্ষুনি আসছি, মাও থাকবে সেখানে" এই  মিথ্যে সান্তনা দিয়ে মীনাকে রাজি করিয়েছিলেন ভবানী সন্ন্যাসীদের সাথে যাওয়ার জন্য। হৃদয় নিঙড়ানো কষ্ট নিয়ে মেয়ের হাত তুলে দিয়েছিলেন শৃঙ্খলকদের হাতে। চোখের পলক না ফেলতে মিলিয়ে গিয়েছিল মীনা, সঙ্গে ছয় সন্নাসীও। অন্ধকার ঘরে, স্ত্রীর মৃতদেহ পাশে একলা রয়ে গিয়েছিলেন ভবানী।

বইদাদু বলেছিলেন, ভবানীচরণ নিরুদ্দেশ হয়ে যান সেই রাত্তিরেই। তারপর আসতে আসতে দর্পনপুর ভুলে যায় ভবানীচরণ, তাঁর স্ত্রী আর মীনার কথা।  এর অনেকদিন পরে, বইদাদু যখন ১৬-১৭, ভবানী ফেরত এসেছিলেন একবার। দিন দশেক থেকে আবার নিরুদ্দেশ। তারপর আর ভবানীচরণের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।  সেইসময়ই হয়তো রেখে যান এই খেরোর খাতাটা।

"তোকে কি করতে হবে,  তার থেকেও বড় একটা প্রশ্ন আছে একটা রিজু এখানে"- অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর গলায় এতক্ষন বাদে প্রথম কথা বলে পলা, "তুই যদি সূত্রধার হোস, আর নাজিয়া বা নন্দিনী অসঙ্গতি, তাহলে আমাদের উমাশঙ্করটা কে?"
-"অরুণাভদা" দিপু  উত্তর দেয়।  .
-"মানে?" সৌম্য  প্রশ্নটা করে, কিন্তু ওরা তিনজনেই তাকায় দিপুর দিকে।
-"না, মানে  অরুণাভদা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। "

কথা বলতে বলতে ওরা খেয়াল করেনি, কিন্তু অরুণাভদার বাড়ির সামনে চলে এসেছে ওরা। ছোট একতলা বাড়ি, সামনে একটু বাগানমতো। সেই বাগানেই দাঁড়িয়ে আছে অরুণাভদা।
অরুণাভ সান্যাল। আরশিপুরের নামকরা ফিজিক্সের প্রাইভেট টিউটর। এককালে আরশিপুর কলেজের ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল, আমেরিকার এক বিখ্যাত উনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে গিয়েছিল। শোনা যায়  প্রচন্ড রকমের একগুঁয়ে আর জেদি ছিল, কোন একটা প্রজেক্টের পিছনে সব সময় কাটিয়ে দেয়, কিন্তু সেই কাজে কোনো ফল আসে না, অথচ পিএইচডি সুপারভাইসর অনেক বলা সত্ত্বেও সে প্রজেক্ট পাল্টায়নি। শেষ পর্যন্ত পিএইচডি ছাড়াই ফিরে আসতে হয় দেশে, সে আজ প্রায় বছর দশেক। এখানে এসেও  অরুণাভ কোনো চাকরির চেষ্টা করেনি, সন্ধ্যেবেলা টিউশন করে আর সারাদিন নিজের সেই অসমাপ্ত কাজ নিয়েই পড়ে থাকে। মা-বাবা দুজনেই গত হয়েছেন ইতিমধ্যে, বিয়ে-টিয়েও করেনি। আরশিপুরের একপ্রান্তে বাবার রেখে যাওয়া ছোট একতলা বাড়িতে থাকে, পুরোপুরি একলা। তবে অরুণাভদা পড়ায়  খুব ভালো।  বইয়ের পড়ার বাইরেও এটা-সেটা অনেক কিছু বলে ওদের, বিষয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে পারে।
সৌম্য নিজের হাতঘড়িটা দেখে বলে, "একটু তাড়াতাড়িই এসে গেছি আমরা। আর কেউ আসেনি মনে হচ্ছে এখনো। যাক ভালোই হয়েছে, রিজু তুই অঙ্কগুলো টুকে নিতে পারবি।"
বাগানের দরজা ঠেলে ঢোকে ওরা, সাইকেল রাখে। অরুণাভদা হাসে একটু ওদের দিকে তাকিয়ে, "কি, চারমূর্তি? আজ তাড়াতাড়ি যে?"
পাল্টা হেসে ওরা এগোয় অরুণাভদার বাড়ির দরজার দিকে। ওরা, মানে সৌম্য, দিপু, আর রিজু। কিন্তু পলা পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সাইকেলগুলোর পাশেই। অরুণাভদাই প্রথম খেয়াল করে ব্যাপারটা, তারপর জিজ্ঞাসা করে, "কিরে, পলা, দাঁড়িয়ে গেলি কেন ?"
রিজুরা তখন প্রায় দরজার মুখে। ওদের খেয়ালই হয়নি যে পলা আসছে না ওদের সাথে। অরুণাভদার কথা শুনে ওরা  পিছন ফিরে তাকায়, আর পলার মুখটা দেখে বুকের ভিতরটা খালি হয়ে যায় রিজুর।
পলার মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেছে। রিজুদের দিকে একবার তাকিয়ে সে  অরুণাভদার চোখে চোখ রাখে। তারপর বলে, "অরুণাভদা, বাকিদের আসতে বারণ করে দাও আজ। তোমার শুধু আমাদের সাথে কথা বলাটা খুব জরুরি।"

পলার এই কথাটা বলার ঘন্টাখানেক পরে, রিজু সৌম্যর ফোন থেকে মাকে ফোন করে, "মা, রিজু বলছি। আমরা চারজন আছি, আমি পলা, দিপু আর সৌম্য। আমরা  এক্ষুনি বাড়ি আসছি, তুমি বাবার সাথে যোগাযোগ করো; ভীষণ দরকার!"

পর্ব-১৪

সমাপ্তির সূচনা 

অরুনাভ তার ক্লাস টুয়েলভ ব্যাচের ছাত্রছাত্রীদের কয়েকজনকে ফোন করে জানাচ্ছিল আজ পড়তে আসার প্রয়োজন নেই; সে আজ ব্যস্ত। সাধারণত সে এরকম ভাবে টিউশন ক্লাস অফ করে না, কিন্তু পলার মুখ দেখে অরুনাভ বুঝেছিল কিছু একটা জটিল সমস্যা সত্যিই আছে। পলার বাকি তিন বন্ধুকে দেখেও মনে হচ্ছিলো তারা একটা অস্বস্তিতে আছে। সে ওদের পড়ার ঘরে বসতে বলে বারান্দায় ফোন করতে এসেছিলো।
ঘরের মধ্যে পলা তখন খাটের ওপর দুটো হাত মুঠো করে বসে আছে। হাত দুটো মুঠো না করে রাখলে ঠকঠক করে কাঁপছে তার হাতের তালু। ঘরে একটা ছোট খাট, আর মেঝেতে মাদুর বিছানো। পড়ানোর সময় ওই মাদুরেই বসে পড়ায় অরুণাভদা।
-"পলা, কি হয়েছে তোর?" সৌম্য আর ধৈর্য রাখতে পারে না।
-সৌম্য, তোর মনে আছে, অরুণাভদা কি নিয়ে রিসার্চ করে ?"

সৌম্যর ভ্রূদুটো একবার জড়ো হয়, একটু ভাবে সে। তারপরেই সেও ধপ করে বসে পড়ে খাটে, পলার পাশে।
রিজুর মনে পড়ে কয়েকদিন আগের কথা।  সদ্য ইলেভেনের পরীক্ষা শেষ হয়েছে, তখনও শৃঙ্খলকের আগমন ঘটে নি। অরুণাভদা পড়াচ্ছিলো ওদের, কেউ একজন, খুব সম্ভব সৌম্যই, প্রশ্ন করেছিল, "অরুণাভদা, তোমার রিসার্চটা কী নিয়ে ?"
অরুনাভ হেসে জবাব দিয়েছিল, "সে বড় শক্ত জিনিস। কিন্তু বড় মজারও।"
ওরা জেদ করেছিল, শুনবে।
হাতের দোয়ারির বইটা বন্ধ করে গল্প বলার মতো করে বলতে শুরু করেছিল অরুনাভ,
-"একটা গল্প শোন তার আগে। ১৯৫৫ সাল। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতেন মার্কিন বৈজ্ঞানিক হিউ এভারেট, তখনও ছাত্র, পিএইচডি করছেন। হিউ-এর গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল বহু-বিশ্ব তত্ত্ব, মেনি ওয়ার্ল্ড থিওরি।বলা ভালো হিউ-ই বহু-বিশ্ব তত্ত্বের প্রণেতা। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত তাঁর পিএইচডি থিসিসে তিনি বিষয়টি প্রথম তুলে ধরেন। অবশ্য তত্ত্বটিকে জনপ্রিয় করেছিলেন অন্য এক মার্কিন বৈজ্ঞানিক, ব্রায়াস দেউইট।

"আমি এই বহু বিশ্ব-তত্ত্বের ওপরই কাজ করি। হিউ-এর মত অনুসারে,আমাদের প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত, একটা  করে নতুন বিশ্বের জন্ম দেয়। ধর, আজ সকালে উঠে তুই ভাবছিলি, তুই ফিজিক্স পড়বি, নাকি কেমিস্ট্রি। তুই হয়তো ফিজিক্সই পড়েছিস, কিন্তু তোর ওই ভাবনা থেকে একটা সম্পূর্ণ নতুন বিশ্ব তৈরি হয়েছে, যেখানে অন্য একটা সৌম্য সকালে উঠে কেমিস্ট্রি পড়েছে। এরকমভাবে, আমাদের প্রতিটা ভাবনা, আর সিদ্ধান্ত এক-একটা নতুন বিশ্বের জন্ম দিয়ে চলেছে প্রতি মুহূর্তে।

"এবার প্রশ্ন হলো, তাহলে কখনো কি এইরকম দুটো জগতের দুজন সৌম্য'র মধ্যে দেখা হতে পারে? এভারেট বলেছিলেন, না। প্রত্যেকটা জগৎ, পরস্পরের সাথে নিখুঁত ভাবে সমকৌণিক। তারা ছেদবিন্দু থেকেই জন্ম নেয়, তারপর নিজের মতো সরলরেখায় চলে, দ্বিতীয়বার ছেদ করার সুযোগ নেই।

"আমি ঠিক এই জায়গাটাতেই হিউ এভারেটের সাথে একমত নই।  আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তোদের মতোই বয়স, আমাদের অঙ্কের  টিচার এই বিষয়টা আমার মাথায় ঢুকিয়েছিলেন। এইরকমই ক্লাসের মধ্যে গল্প করেছিলেন তিনি একবার এভারেট আর তার বহু-বিশ্ব তত্ত্ব নিয়ে। তিনিই প্রথম বলেছিলেন, প্রকৃতিতে কিছুই নিখুঁত সরলরেখা, বা নিখুঁত সমকোণ হতে পারে না। নিখুঁত সরলরেখা মানুষ তৈরি করে। সুতরাং, এরকম হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক নয়, যে এইরকম অসংখ্য জগতের মধ্যে দুটি জগৎ সমকোনের থেকে অনেক ছোট কোণে এগিয়ে চলেছে। এরকম যদি হয়, তবে সেই দুটি জগৎ পরস্পরের অনেক কাছাকাছি; সুতরাং সেক্ষেত্রে এমনটাও হতে পারে কোনোভাবে তাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। আমি সেটাই চেষ্টা করে যাচ্ছি...."

চুপ করে গিয়েছিল অরুণাভ, আর কিছু বলে নি।  তারপর হাতের বইটা ফের খুলে বলেছিল,
-"যাইহোক এসব ঠিক করে বুঝতে অনেক সময় লাগবে তোদের এখন। আপাতত ৫.৬২ কে বাইনারি নম্বরে কনভার্ট কর বসে বসে। "
ঘটনাটা মনে করে রিজুর মাথার মধ্যে একটা ঝড় বইতে শুরু করে; তবে কি....তাহলে কি....
অরুণাভদা ঘরে ঢোকে এইসময়, "পলা, এইবার বল কি বলছিলি?"

সৌম্য উত্তর দেয়, "অরুণাভদা, তুমি বহু-বিশ্ব তত্ত্বের কাজটা কতদূর এগিয়েছো? তুমি কি জিনিসটা নিয়ে কোনো এক্সপেরিমেন্ট করছিলে?"
অরুনাভ'র ভ্রূ কুঁচকে যায়, "কেন বলতো?"
-"প্লিজ, তুমি আগে উত্তরটা দাও, জীবন-মরণ নির্ভর করছে কিছু মানুষের এই মুহূর্তে আমাদের ওপর, হয়তো তোমার জীবনও। আমরা বলছি তারপর।" পলা বলে ওঠে।
অরুনাভ অবাক হয়ে বলে, "কিসব বলছিস বলতো? কি হয়েছে ?"
-"আগে তুমি। "
সন্ধিগ্ধ চোখে একবার জরিপ করে অরুনাভ চারজনকে। তারপর বলে,
-"হ্যাঁ, আমি এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম। আমার মনে হয় আমি অনেকদূর এগিয়েছি অন্য বিশ্বের অস্তিত্ব প্রমান করাতে। কিন্তু এখনো কোনো সঠিক প্রমান নেই আমার হাতে। আসলে তোদের সাথে সেদিন কথা বলার পর আমার মনে পড়ে যায় আমার সেই অঙ্কের  টিচারের কথা।  উনি বলতেন, যদি কেউ বারবার একই ভাবে, খুব কম সময়ের ব্যবধানে একই রকমের একাধিক  বিশ্ব তৈরি করার চেষ্টা করে চলে, তবে হয়তো এরকম দুটি বিশ্ব তৈরি করা সম্ভব, যাদের মধ্যে ব্যবধান খুব কম।  উনি ক্লেম করতেন, উনি একবার সফলও হয়েছিলেন। কিভাবে সফল হয়েছিলেন, সেটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। তোদের সাথে সেদিন কথা বলার পর, এইসব নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে করতে, অবশেষে মনে পড়ে।
তারপর আমি অবিকল ওনার পরীক্ষাটা করার চেষ্টা করেছিলাম। একসপ্তাহের পর, অবশেষে, সফল হই। কিন্তু তারপর থেকে আর- কিন্তু তোরা এইসব কেন জানতে চাইছিস?"

পলা বলে ওঠে, "পরীক্ষাটা কি ছিল, অরুণাভদা?"
-"লাইটবাল্ব এক্সপেরিমেন্ট। আমি বহুদিন ধরে এক্সপেরিমেন্টটা করার চেষ্টা করছি। একটা বাল্বের সুইচ তোর সামনে আছে, তুই সেটার দিকে তাকিয়ে বারবার ভাবছিস, সেটা তুই জ্বালাবি, নাকি জ্বালাবি না। যতবার তুই বাল্বটা জ্বালাচ্ছিস, ততবার অন্য একটা বিশ্ব তৈরি হচ্ছে, যেখানে তোর কাউন্টারপার্ট বাল্বটা জ্বালাচ্ছে না। আর ঠিক এখানেই ভুলটা করছিলাম আমি।  আমার অংকের স্যার বলেছিলেন, তিনি বাল্বটা বারবার না জ্বালানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন। এবং কোনো একদিন, বাল্বটা হঠাৎ করে জ্বলে উঠেছিল, যদিও তিনি সুইচে হাত পর্যন্ত দেন নি। কথাটা মনে করার পর আমি একসপ্তাহ ধরে একটা বাল্বের দিকে তাকিয়ে বসে থেকেছি; অবশেষে একমাস আগে একদিন বাল্বটা জ্বলে ওঠে। কিন্তু তারপর আবার যে কে সেই।"

পলা একটা নিশ্বাস ফেলে, "অরুণাভদা, এই এক্সপেরিমেন্টটা নিশ্চয় মোমবাতি দিয়েও করা যেতে পারে?"
-"টেকনিক্যালি, হ্যাঁ, যেতেই পারে।"
-"অরুণাভদা, উমাশঙ্কর রায়চৌধুরীর নাম শুনেছ?" দিপু বলে ওঠে।
অরুণাভ দিপুর দিকে তাকায়, "হ্যাঁ, খুব বেশি লোক জানে না ওনার কথা।  আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি তোরা জানিস দেখে। মেনি ওয়ার্ল্ড থিওরি যেসময় এভারেট ফর্মুলেট করছেন প্রিন্সটনে বসে, সেই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের প্রফেসর ছিলেন তিনি। উনি নাকি এই শহরেরই ভূমিপুত্র; শোনা যায় এভারেটের বন্ধু ছিলেন তিনি, চিঠি-পত্র চলত দুজনের। আমার সেই অঙ্কের স্যারই  বলেছিলেন ওনার নাম। স্যার-এর কথায়, কেউ কেউ  বলে উমাশঙ্কর নাকি প্রমান করতে পারবেন বলেছিলেন বহু-বিশ্বের অস্তিত্ব। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ, খুব কম বয়সে উনি...."
সৌম্য অরুণাভর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কথাটা শেষ করে,
-"মারা যান".
-"হ্যাঁ, তোরা কি করে..."
কিন্তু এবারও  তাকে কথা শেষ করার সুযোগ দেওয়া হয় না, রিজু কথা বলে ওঠে।  সে নিজের মতো কিছু একটা ক্যালকুলেশন করছিলো এতক্ষন,
-"অরুণাভদা, তোমার এই স্যার-এর নামটা কি?"
-"অজিত, অজিত দত্ত।"

চোখটা বন্ধ করে রিজু, "আমার মায়ের দিকের দাদু ছিলেন উনি।  পলা, সৌম্য, নন্দিনীর কানেক্শনটা এবার একটু একটু বুঝতে পারছি। নন্দিনীর হারিয়ে যাওয়াটাও।"
অরুণাভ এবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়, "অজিতদা তোর দাদু ছিলেন? জানতাম না! আর এই নন্দিনী কে?"
পলা, দিপু, সৌম্য, আর রিজু একে ওপরের দিকে তাকায়। অরুণাভদাকে সবটুকু খুলে বলার সময় এসেছে এবার।
নন্দিনীকে দিয়েই শুরু করে ওরা।  দশ বছর আগে,ওরা চারজন আর নাজিয়া লুকোচুরি খেলছিল রিজুর বাড়িতে। নন্দিনীও ছিল ওদের সাথে। সেই সময়ই বাড়ি থেকে বেমালুম উধাও হয়ে গিয়েছিল নন্দিনী। সে সম্পর্কে রিজুর মাসি, বয়সে অনেকটাই বড় ওদের থেকে। কিন্তু নন্দিনীর মানসিক বৃদ্ধি হয় নি, তাই আঠেরো বছর বয়সেও  নিজের থেকে আট বছরের ছোট রিজু আর তার বন্ধুদের সাথেই খেলা-ধুলো করতো সে। রিজুর বাবার ঘরে লুকোতে গিয়েছিল নন্দিনী, অন্তত নাজিয়া সেই কথাই বলে। তারপর তাকে আর কেউ খুঁজে পায় নি।

রিজু এইটুকু বলে চুপ করে যায়।  সৌম্য এরপর রিজুর শৃঙ্খলকদের দেখা থেকে শুরু করে, রিজু সেদিকে কান না দিয়ে ভাবতে থাকে, বাবার ঘরে ঢুকেছিল নন্দিনী। মা আর বাবার মধ্যে ঝামেলাও হয়েছিল সেটা নিয়ে, অল্প মনে আছে রিজুর। বাবা বলেছিলেন, "তিন্নি এই জগতের কেউ ছিল না"! বাবা কি তাহলে এইসব জানতেন ? একে একে মনে পড়তে থাকে রিজুর, বাবার ঘরটাকে মা মাঝেই মাঝেই অজিতদার ঘর বলে ফেলে এখনও; বাবা ওই ঘরেই থাকতেন। বইদাদুও বলেছিলেন, 'দর্পনপুরের অজানা ইতিহাস' বইটা গোকুলবিহারীর কাজে এসেছিলো।  গোকুলবিহারী তার ঠাকুরদা, বাবার বাবা।
একটু ভেবে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নেয় রিজু। তারপর উঠে সৌম্যর থেকে ফোনটা চেয়ে বারান্দায় চলে যায়। দিপু তখন অরুণাভদাকে বলছে ভবানীচরণের গল্প। মাকে ফোন করে ঘরে ঢোকে রিজু।  পলা, সৌম্যরা উঠে দাঁড়িয়েছে, ওদের মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
পলাই বলে কথাটা, "রিজু, নাজিয়া ফোন করেছিল।  ওদের কুকুরটাকে কেউ মেরে রেখে গেছে বাড়ির দরজার সামনে। "

-----------------------------------------------------------------------
A/N: গল্পটা, কল্পবিজ্ঞান; বিজ্ঞান আর কল্পনার মিশেল। আর একজন বিজ্ঞানের ছাত্রী যখন কল্পবিজ্ঞান লেখে, তার দায় থাকে পাঠককে কল্পনা আর বিজ্ঞানকে আলাদা করে জানানোর। হিউ এভারেট আর মেনি ওয়ার্ল্ড ইন্টারপ্রিটেশন বিজ্ঞান।  সমকৌণিক বিশ্বের অস্তিত্ব বিজ্ঞানের আওতায়।  বাকিটা কল্পনা। বাকি সবটাই, কল্পনা; এমনকি উমাশঙ্কর রায়চৌধুরীও।
--------------------------------------------------------------------------


পর্ব-১৫

সম্ভাব্য সমাধান?

ঘর অন্ধকার করে চুপ করে বসেছিল নাজিয়া। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তার আর কিছুই ভালো লাগে না; পড়তে বসলে মাথা যন্ত্রনা করে, পড়তে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বন্ধুরা ডাকলে এড়িয়ে যায় শরীর ভালো নেই বলে। মাও সেই ঘটনার পর থেকে দিনের বেশির ভাগ সময় নিজের ঘরেই থাকেন, নাজিয়ার সাথে কথাও হয় না দিনে দু-একটার বেশি। এমনকি নাজিয়ার মাঝে মাঝে মনে হয়, মা নাজিয়াকে এড়িয়ে চলেন।
 টম, একমাত্র টমই নাজিয়ার বন্ধু ছিল এই একটা মাস। নাজিয়া মন খারাপ করে কম্বলের নিচে শুয়ে থাকলে কাছে এসে ভেজা নাক দিয়ে ঠেলে তুলতো ওকে, তার পর ওর সাথেই বসে থাকতো। টমের সাথে থাকলে মনটা ভাল থাকত তাও একটু। কিছুদিন হল সন্ধ্যে হলে টমকে নিয়ে হাঁটতে যাওয়া শুরু করেছিল নাজিয়া। আজও নাজিয়া সন্ধ্যে বেলা বারান্দায় গিয়েছিল টমকে  নিয়ে বেরোবে বলে।  বদলে ও দেখে, টমের প্রাণহীন দেহটা পড়ে আছে। বীভৎস দৃশ্য। কোটর থেকে চোখ বেরিয়ে এসেছে, মুখটা সামান্য হাঁ হয়ে আছে। কেউ যেন গলা টিপে মেরেছে কুকুরটাকে। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে কাঁদতে কাঁদতেই মায়ের ঘরে গিয়েছিল নাজিয়া, গিয়ে দেখে মা নেই। ফোন করে ও মাকে, ফোন বেজে ওঠে ঘরের মধ্যেই। কি করবে কিছু ভেবে না পেয়ে পলাকে ফোন করে নাজিয়া।
পনেরো মিনিটের মধ্যেই ডোরবেল বেজে ওঠে।  পলা আর সৌম্য এসেছে, সাথে অরুণাভদা। নাজিয়া দরজাটা খুলতে নাজিয়াকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে জড়িয়ে ধরে পলা ,"নাজি, তোর সাথে কথা আছে।" নাজিয়া লক্ষ্য করে, ওদের তিনজনেরই মুখে ভয়।
নাজিয়ারদের বাগানেরই এককোনে টমকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করতে শুরু করে ওরা চারজন। তারই সাথে সাথে, সৌম্য আর পলা নাজিয়াকে বলতে থাকে শৃঙ্খলক আর ভবানীচরণের কথা, অরুণাভর রিসার্চের কথা।
----
নাজিয়াদের বাড়ি থেকে ১০ মিনিটের হাঁটাপথ রিজুদের বাড়ি। আর অরুনাভর বাড়ি থেকে নাজিয়াদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় পড়ে বাড়িটা। যেসময় পলা আর সৌম্য অরুণাভকে নিয়ে নাজিয়ার দরজায় পৌঁছয়, ততক্ষনে রিজু আর দিপু রিজুর বাবার সাথে কথা বলছে ভিডিওকলে।
বাড়িতে ঢুকে সর্বানীর হাজারো প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে ওরা সোজাসুজি কম্পিউটারে বসে গিয়েছিল; কল কানেক্ট হওয়ার পরে, রিজুর প্রথম প্রশ্ন ছিল বাবার কাছে, "বাবা, নন্দিনীর সাথে কি হয়েছিল?"
সঞ্জীব সন্দেহের চোখে ছেলেকে দেখেন একবার; তারপর একবার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সর্বানীর  দিকে তাকান । সর্বানীর চোখেমুখে নিখাদ বিস্ময়। সঞ্জীব বলতে শুরু করেন, "তুই তো জানিস কি...."
বাবাকে থামিয়ে দিয়ে, বিরক্তি আর অধৈর্য মেশানো গলায় রিজু বলে ওঠে, "সত্যিটা জানতে চাইছি বাবা, খুব দরকার সত্যিটার। গত একমাস ধরে আমি শৃঙ্খলকদের দেখছি বাড়ির সামনে।"
শৃঙ্খলকদের নাম শোনামাত্র সঞ্জীবের মুখ বিবর্ণ, ফ্যাক্যাশে হয়ে যায়।  নিজের আশ-পাশটা একবার দেখে নেন তিনি। তারপর গলা নামিয়ে বলেন , "কতটা জানিস তোরা?"
দিপু আর রিজু পালা করে বলতে শুরু করে নাজিয়া, অরুনাভ, আর বইদাদুর গল্প।
---
মাটিতে খোঁড়া দুইফুটের গর্তটায় টমকে শুইয়ে দেয় নাজিয়া। তারপর বাগান থেকেই তোলা একটা ফুল রেখে দেয় টমের নিথর শরীরটায়। চারপাশের জড় করা মাটি ফেলতে শুরু করে ওরা তারপরটমের শরীরের ওপর। নাজিয়ার মাথার মধ্যে সবকিছু জট পাকিয়ে গেছে।  পলা, সৌম্যরা কি বলতে চাইছে? নাজিয়া এই জগতের কেউ নয় ? রিজু কয়েকজন সন্ন্যাসীকে দেখতে পায় রোজ রাত্তিরে  যারা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় নিজের জগতে ? আর যদি সে যেতে রাজি না হয়, তাহলে তারা একে একে তার কাছের লোকজনদের খুন করবে ?
-"একদমই তাই।  আর দ্যাখ, ঘটনাগুলো মিলেও তো যাচ্ছে। অরুণাভদার রিসার্চ প্রমাণ করে অন্য জগতের অস্তিত্ব আছে; এবং খুব সম্ভবতঃ, অরুণাভদার এক্সপেরিমেন্টের জন্যই এই গন্ডগোলটা বেঁধেছে। তুই পলাকে বলেছিলি আকসিডেন্টের দিন গাড়ির সামনের সিটে আন্টি ছিলেন। এদিকে দিপুর মাকে  আন্টি  বলেছেন সামনের সিটে তুই ছিলি। আমরা ভাবছিলাম তোদের কেউ একজন ভুল বলছে। কিন্তু তোরা দুজনেই ঠিক বলছিস হয়তো। হয়তো তোদের ওই ডিসিশনটাই আর একটা  ওয়ার্ল্ডের জন্ম দিয়েছিল, যেখানে তুই ছিলি সামনের সিটে।" একটু দম নেয় সৌম্য।
অরুণাভ বলতে শুরু করে, "নাজিয়া, আমি আমার এক্সপেরিমেন্টের লগবুক মিলিয়ে দেখেছি, যেদিন তোদের এক্সসিডেন্ট হয়, সেইদিনই আমার এক্সপেরিমেন্টটা সফল হয়েছিল। এরকম পসিবল যে আমার বারবার করে একই এক্সপেরিমেন্ট করার কারণে, দুটো কাছাকাছি জগতের মধ্যে একটা টানেল তৈরি হয়েছিল। যার ফলে-" অরুনাভ কথাটা শেষ করার আগেই পলার ফোন বেজে ওঠে। ফোনটা ধরতে ওপর প্রান্তে রিজুর গলা শোনা যায়, "পলা, তোরা এখানে আয়, একটা উপায় পাওয়া গেছে; নাজিয়াকে নিয়ে আসিস। যদি আমরা সফল হই, অন্তত কেউ মারা যাবে না। "
----

-"অজিতবাবু ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি। তিনি উমাশঙ্করের এক্সপেরিমেন্টটা নিজে সফলভাবে করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুদক্ষ বৈজ্ঞানিকের মতো নিজের এক্সপেরিমেন্টের ডিটেলস লিখেও  রেখে গিয়েছিলেন তিনি।  তোমার মনে আছে বিনি, তিন্নি একবার অজিতবাবুর একটা ছবি এঁকেছিল? যখন আমার পা মচকে যায়?"
সঞ্জীবের কথায় ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলেন সর্বানী; সঞ্জীব আবার বলতে শুরু করেন, "সেই ঘটনার পর থেকেই আমি অজিতবাবুর খাতা পত্র নিয়ে ঘাঁটা শুরু করি।  অজিতবাবুর একটা ডায়েরিও ছিল তার মধ্যে। তুমি জানো কিনা আমার জানা নেই, তোমার মা অজিতবাবুকে বলেছিলেন, তিন্নির জন্মানোর কথা ছিল না। সুব্রতবাবু ,মানে তোমার নিজের বাবা, আর তোমার মা ডিসিশন নিয়েছিলেন দ্বিতীয় সন্তান না নেওয়ার।  সেইমত তোমার মা কন্ট্রাসেপ্টিভ পিলও খেতেন। তবুও তিন্নির জন্ম হয়। তোমার মায়ের ধারণা ছিল তিন্নির ঠিক করে কথা বলতে না পারার কারণ সেটাই। আমার নিজের ধারণা একটু অন্যরকম ব্যাপারটা নিয়ে।

"অজিতবাবু যেটা জানতেন না, সেটা হল ভবানীচরণ চট্যোপাধ্যায়ের ইতিহাস। আমি নিজেও ব্যাপারটা জানতে পারতাম না, যদি না লাইব্রেরিয়ান আশীষবাবু আমার বাবার বন্ধু হতেন। উমাশঙ্করের মোমবাতির ম্যাজিক, তাঁর ওই শোচনীয় মৃত্যু আর ভবানীচরণের মৃত মেয়ের ফিরে আসার ঘটনায় আমার একটু খটকা লাগে। আমি হিসেব করে দেখি, অজিতবাবু যেসময় নিজের এক্সপেরিমেন্ট-এ সাফল্য পেতে শুরু করেছিলেন, তিন্নির জন্ম ঠিক সেই সময়। বহু-বিশ্ব তত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করে আমার মনে একটা ধারণা তৈরি হয়, তোমার বাবা এবং মার এই  দ্বিতীয় সন্তান নেওয়া নিয়ে আলোচনা এবং ডিসিশন, সেটা দুটো প্রায় একইরকম বিশ্বের জন্ম দিয়েছিল; একটিতে ওনারা সন্তান নিতে রাজি ছিলেন, অন্যটিতে ছিলেন না। আর ঠিক তখনি, অজিতবাবুর এক্সপেরিমেন্ট দুটি জগতের মধ্যে একটা গন্ডগোল বাধায়; একটা টানেল তৈরি করে; আর তিন্নি কন্সিভ হয় সেই জগতে, যেখানে তার জন্ম নেওয়ার কথা ছিল না।

"পুরো ব্যাপারটা বুঝে আমি একটু ভয় পেয়ে যাই; তার প্রধান কারণ ছিল, বিনি, তোমাদের  পরিবারে মৃত্যুর ইতিহাস। যতদিনে আমি গোটা ব্যাপারটা বুঝেছি, ততদিনে আমার নিজের মাও মারা গেছেন; আর তিন্নি থাকে বিতানের সাথে। মৃত্যুগুলোর প্রত্যেকটার কারণ ছিল খুব সম্ভবত যারা মারা গিয়েছিলেন, তারা শৃঙ্খলকদের বাধা দিতে চাইতেন তিন্নিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।

"আমার ধারণা যে মিথ্যে নয়, বিতান হারিয়ে যাওয়ার পর সেই বিশ্বাস আমার মধ্যে বদ্ধমূল হয়। আমার নিজস্ব ধারণা, বিতানকেও শৃঙ্খলকরা মেরে ফেলেছেন, কিন্তু তার দেহ অন্য কোনো দুনিয়ায়....

"যাই হোক, পুরোটা বোঝার আমার খুব অসহায় লাগতে শুরু করে গোটা ঘটনাটা নিয়ে, কারণ আমি নিজে সূত্রধার ছিলাম না, আর ভবানীচরনের লেখা অনুযায়ী সূত্রধার ছাড়া কেউ নিজে থেকে যোগাযোগ করতে পারে না শৃঙ্খলকদের সাথে। যদি কোনো ভাবে আমি তিন্নিকে ব্যাপারটা বোঝাতেও পারি, তাকে নিজের দুনিয়ায় ফেরত পাঠানোর কোনো ক্ষমতাই আমার ছিল না।  সামান্য একটা সূত্র খোঁজার জন্য আমি তিন্নির জন্ম থেকে শুরু করে সব কটা মৃত্যু নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে বসি; তখন বিতান সদ্য হারিয়ে গেছে। আমি  দেখি, প্রত্যেকটা মৃত্যুর সময়ের মধ্যে কমবেশি একটা ছন্দ রয়েছে।

"সুব্রতবাবুর মৃত্যুর কমবেশি পাঁচবছর পর, বিনি, তোমার ঠাকুরদা মারা যান।  তার দুইবছর পর অজিতবাবু আর তোমার মা। তার পাঁচবছরের মাথায় আমার নিজের মা, আর তারও দুইবছরের মাথায় হারিয়ে যায় বিতান। এই সময়ের হিসেবটা আমাকে একটু ভরসা দেয়, আমার একটা ধারণা হয়, এই দুই জগৎ নিজে থেকেই  পিরিওডিক্যালি কাছাকাছি আসে, কেউ কোনো টানেল না খুললেও; আর তখনি আবির্ভাব হয় শৃঙ্খলকদের। আমার হাতে পাঁচ বছর সময় আছে, সেটা মাথায় নিয়ে আমি পড়াশুনো করতে থাকি এই সব কিছু নিয়ে। উমাশঙ্করের লেখা একটা প্রবন্ধ হাতে আসে আমার; কলকাতা উনিভার্সিটির পুরোনো আর্কাইভ থেকে।  'মনন-শক্তি, ও বহু-বিশ্বে তার প্রভাব'। উমাশঙ্কর লিখেছিলেন, যদি কেউ চায়, তাহলে ব্রেন এবং ইচ্ছাশক্তি কাজে লাগিয়ে অন্য জগতের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে।

"বিতান হারিয়ে যাওয়ার পঞ্চম বছর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি চেষ্টা করতে শুরু করি শৃঙ্খলকদের সাথে যোগাযোগ করার। মোমবাতি জ্বালিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতাম, আর মনে মনে কল্পনা করতাম শৃঙ্খলকদের কথা। অবশেষে একদিন আমি সক্ষম হই, গভীর রাতে ছয় সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটে আমার ঘরের ভিতর।

"পরের দিন তিন্নি যখন আমার ঘরে লুকোতে আসে, তার সাথে কথা বলি আমি; তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি, সে যদি এখানে থাকে, তাহলে এক এক করে সবাই মারা যাবে হয়তো। তিন্নি রাজি হয়ে যায় সন্ন্যাসীদের সাথে যাওয়ার জন্যে, আর শৃঙ্খলকরা যাওয়ার আগে এই দুই জগতের মধ্যেকার টানেলটা, যেটা অজিতবাবু  খুলেছিলেন, সেটা বন্ধ করে দিয়ে যান। "

সঞ্জীব একটু থামেন, তারপর  রিজু আর দিপুর দিকে তাকিয়ে বলেন, "তোদের থেকে যা শুনলাম, তাতে আমার মনে হয়, অরুনাভর এক্সপেরিমেন্ট দশ বছর পরে আবার একটা টানেল তৈরি করেছে দুই ভিন্ন জগতের মধ্যে; আর তার ফলেই, মৃত্যুর পরেও নাজিয়ার আগমন। কিন্তু  একটা সুবিধা আছে, তোদের মধ্যে একজন সূত্রধার রয়েছে।  রিজু, তুই চাইলে নিজে থেকে কন্টাক্ট করতে পারিস শৃঙ্খলকদের। তোদের উচিত  নাজিয়াকে রাজি করিয়ে নিজের দুনিয়ায় ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা।"
----
অজিতবাবুর পুরোনো ঘরে, আলো  নিভিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে ওরা সাতজন রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে । ঘর থেকে জিনিসপত্র বাইরে বার করে ফাঁকা করেছে ওরা ঘরটা।  রিজু একদৃষ্টে মোমবাতির দিকে তাকিয়ে আছে; ওর উল্টো দিকে নাজিয়া। নাজিয়ার দুইপাশে পলা আর সৌম্য দাঁড়িয়ে। অরুণাভ, সর্বানী, আর দিপু দাঁড়িয়ে আছেন একটু দূরে, দরজার কাছে। নাজিয়া প্রথমে পলাদের সাথে কিছুতেই আসতে চায় নি।  কিন্তু পলা ওকে অবশেষে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে,  অন্য কিছু না হোক, অরুণাভর মৃত্যু আটকানোর এটাই একমাত্র উপায়। রিজু শৃঙ্খলকদের সাহায্য করবে নাজিয়াকে অন্য জগতে ফেরত নিয়ে যেতে, যদি শৃঙ্খলকরা রাজি  হয়ে যান অরুণাভকে শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে। আর যদি নাজিয়া না রাজি হয়, তবে টম-এর মতো হয়তো ওর মা, এবং অন্যান্য কাছের মানুষদের মৃত্যুও আসন্ন।
মায়ের কথা ভেবেই রাজি হয়ে যায় নাজিয়া। কিন্তু আসার আগে মায়ের সাথে দেখা হয় নি তার।  একটা ছোট্ট নোট লিখে রেখে এসেছে সে ডাইনিং টেবিলের উপর, মাকে রিজুদের  বাড়ি আসতে বলে; যদি একবার দেখা হয়ে যায়! কারণ পলারা যা বলছে তা যদি সত্যি হয়, অন্য জগতে আর যেই বেঁচে থাকুক, নাজিয়ার মা বেঁচে নেই।

দপ করে  মোমবাতিটা একবার নিভে যায় এই সময়, তার পরেই আবার জ্বলে ওঠে। ওরা দেখে ঘরের মধ্যে ছয়জন সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে আছেন। কয়েক সেকেন্ড কেউ কোনো কথা বলে না। তারপর গম্ভীর গলায় একজন সন্ন্যাসী বলে ওঠেন রিজুর দিকে তাকিয়ে,
-"সূত্রধার, অবশেষে নিজের নিয়তি মেনে নিয়েছ তাহলে তুমি! অসঙ্গতির দিকে আমাদের নির্দেশ কর এবার তবে! তাকে আমরা এখনো খুঁজে পেতে ব্যর্থ!"
রিজু একবার মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে সাহস খোঁজে। তারপর বলে,
-"আমি অসঙ্গতির কাছে নিয়ে যাব আপনাদের। সেও রাজি আপনাদের সাথে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আপনাদের কথা দিতে হবে, এই জগতের আর কেউ মারা যাবে না. এমনকি যে শৃঙ্খল ভেঙেছে, সেও না। "
সন্ন্যাসীরা একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন। তারপর যিনি আগে কথা বলেছিলেন, তিনি আবার বলেন, -"বেশ, আমরা রাজি। এবার বল, কোথায় খুঁজে পাব আমরা অসঙ্গতিকে?"
 নাজিয়া এক পা এগিয়ে আসে, বলে, "কোথায় যেতে হবে আমাকে?"
সন্ন্যাসী তাকান নাজিয়ার দিকে, "তুমি ? তুমি তো অসঙ্গতি নও!"
হতবাক হয়ে যায় রিজুরা প্রত্যেকে! সন্ন্যাসী রিজুর দিকে তাকান, "এই মেয়েটি অসঙ্গতি নয়। অসঙ্গতি'র চেহারা তো তোমাকে দেখানো হয়েছে, সূত্রধার! খুঁজে বার কর তাকে, না হলে প্রলয় নেমে আসবে এই জগতে!"

মোমবাতিটা আবার নিভে যায়; ফের জ্বলে ওঠার আগেই আলো জ্বেলে দেন সর্বানী। ঘরে শুধু ওরা  সাতজন। রিজু অস্ফুটে বলে, "নন্দিনী! কিন্তু সে তো...."
কলিংবেলটা বেজে ওঠে এই সময়। সর্বানী এগিয়ে যান দরজার দিকে। উদ্বিগ্ন মুখে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন নাজিয়ার মা, সর্বানী গ্রিল গেটটা খুলে দেন, "ফতিমা, এস"!
ফতিমা ম্লান হাসেন। তারপর নিজের ডানহাতটা তুলে হাতটা একবার কপাল থেকে  চিবুক পর্যন্ত বুলিয়ে নিয়ে আসেন, সর্বানী চমকে তাকিয়ে দেখেন, ফতিমার মুখটা পাল্টে গেছে। নতুন মুখটা  খুব চেনা সর্বানীর। হ্যাঁ, চুল লম্বা হয়েছে, আগে ঘাড় অবধি ছাঁটা থাকতো, এখন পিঠের মাঝে ঝুলছে। মুখে বয়সের ছাপও রয়েছে। কিন্তু চিনতে এতটুকু কষ্ট হচ্ছে না।
হাসিটা ধরে রেখেই বারান্দায় পা দিয়ে, পরিষ্কার ভাষায় বলে ওঠে তিন্নি, "ফতিমা নই দিদি, আমি নন্দিনী। "

পর্ব-১৬

সূচনার সমাপ্তি 

সর্বানীর আকস্মিক চমক কাটার অপেক্ষা না করেই নন্দিনী ঢুকে যায় বাড়ির  ভিতরে, "দিদি, নাজিয়াদের বাড়িতে টেবিলে নাজিয়ার নোট দেখে এখানে এলাম আমি; কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আরও অনেক আগে আসা উচিত ছিল আমার। নাজিয়া ওর মা'কে  লিখেছিল যদি তিনি ওর সাথে দেখা করতে চান, তাহলে যেন তাড়াতাড়ি এখানে আসেন, নাহলে আর দেখা হবে না। সে তার নিজের জগতে ফিরে যাচ্ছে, এই জগতের মানুষদের বাঁচানোর জন্যে সেটা জরুরি! সব দেখে মনে হল সঞ্জীবদা নিশ্চয় ভেবেছে নাজিয়া 'অসঙ্গতি', কিন্তু সঞ্জীবদা শৃঙ্খলকদের ডাকার আগে তোমাদের আমার সাথে কথা বলাটা খুব দরকার!"
সর্বানী এতটাই অবাক হয়ে গেছেন, যে তিনি কোন উত্তর দিতে পারেন না।  তিন্নি, যে দিদি শব্দটাও ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারত না, সে এত ভালোভাবে কথা বলছে কি করে! ফতিমা কোথায় তবে ?
উত্তর দেয় রিজু, সে, অরুণাভ এবং তার অন্য বন্ধুরা ততক্ষণে কথা বলার আওয়াজে বেরিয়ে এসেছে অজিতের ঘর থেকে বসার ঘরে, "বাবা নন, অসঙ্গতির দেখা পেলে শৃঙ্খলকদের ডাকার কথা আমার, আমি সূত্রধার। আর বাবা থাকেনও না এখানে আর--কিন্তু নন্দিনী, তুই কি করে....?"
নাজিয়া কথা বলে ওঠে, "আমার মা কোথায় তাহলে ?"
নন্দিনী এক মুহূর্ত চুপ করে নাজিয়ার দিকে তাকায়। তারপর ঘরের সকলের মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নেয়, অবশেষে বলে, "আমি জানি তোমাদের অসংখ্য প্রশ্ন, আমি সব প্রশ্নের উত্তর দেব একে একে; কিন্তু রিজু, তোকে প্রমিস করতে হবে, আমার সব কথা না শুনে তুই শৃঙ্খলকদের সাথে যোগাযোগ করবি না।"
রিজু বলতেই যাচ্ছিল তারা একবার শৃঙ্খলকদের সাথে ইতিমধ্যেই যোগাযোগ করে ফেলেছে, পলার চোখে চোখ পড়ে তার। পলা ইঙ্গিতে তাকে জানায় এখন চুপ থাকতে। নন্দিনী কথা বলতে শুরু করে,
-"দিদি, তুই নিশ্চয় খুব অবাক হচ্ছিস আমি ভালোভাবে কথা বলতে পারি দেখে? দশ বছর আগে শৃঙ্খলকরা যখন আমাকে নিজের দুনিয়ায় ফিরত নিয়ে যায়, আমার ঠিক করে কথা বলতে না পারার সমস্যা সঙ্গে সঙ্গেই দূর হয়ে গিয়েছিল। খুব সম্ভবত এর কারণ, ওই দুনিয়াতে, আমার জন্ম হওয়ার কথা ছিল, এবং সেই দুনিয়ায় আমাদের মা, কোনরকম ওষুধ খেয়ে আমার জন্ম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেননি।ফলতঃ, কন্ট্রাসেপ্টিভের প্রভাব যা ছিল আমার উপর, ওই দুনিয়ায় পা রাখা মাত্র তা দূর হয়ে যায়।  কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্যি ছিল, আমি ওই দুনিয়ায় কখনো জন্মই নিই নি। মা বেঁচে ছিলেন ওখানে দিদি, বাবাও, তোর বিয়েও হয়েছিল সঞ্জীবদার সাথে, কিন্তু আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে তোদের কারো কোনো ধারণাই ছিল না! আঠারো বছর পরে, কখনো জন্মই না নেওয়া মেয়ে যদি হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায়, তাকে কে মেনে নেবে, বল?
-"শৃঙ্খলকদের প্রধান সেই কথাটাই সবার প্রথমে আমাকে জানান। তারপর আমাকে বলেন, অসঙ্গতি এবং তাদের অতিলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে, আর তারই সঙ্গে জানান বহুবিশ্ব, প্রধানবিশ্বপুঞ্জ, এবং পরাবিশ্বের অস্তিত্বের কথা। প্রত্যেক মুহূর্তে, প্রতিটা মানুষের বিভিন্ন মতভেদ, আর সিদ্ধান্তের ফলে, অসংখ্য বিশ্ব তৈরি হয়ে চলেছে; পরাবিশ্ব হল তাদের মধ্যে সবথেকে উন্নত, এবং বৈজ্ঞানিক ভাবে অগ্রসর। পরাবিশ্বের সাথে কিছু দুনিয়া এক বিশেষ ধরণের টানেল দিয়ে যুক্ত, সেই বিশ্ব গুলিকে পরাবিশ্বের মানুষ 'প্রধানবিশ্বপুঞ্জ' বলে থাকেন। বর্তমানে আমরা যে দুনিয়ায় রয়েছি, সেটি একটি অন্যতম প্রধান বিশ্ব। আর পরাবিশ্ব হল সেই দুনিয়া, যারা অন্যসব কয়টা দুনিয়ার উপর নজরদারি করে, এবং যদি কখনও দুটি বিশ্বের মধ্যে কোন যোগাযোগ স্থাপন হয়, সেই যোগাযোগ ছিন্ন করার ব্যবস্থা করে।  শৃঙ্খলকরা হলেন এই পরাবিশ্বের চৌকিদার।
"অসঙ্গতিদের নিয়ে বহু বছর ধরে কাজ করে আসছেন পরাবিশ্বের মানুষ; তারা দেখেছেন, মননশক্তির প্রয়োগে অসঙ্গতিরা অত্যন্ত পারদর্শী। তার কারণ এখনও তাঁদের অজানা, কিন্তু তাই বলে তার সুযোগ নিতে ছাড়েন না তারা।  যখনি কোন মানুষ অসঙ্গতি হয়ে দাঁড়ায়, কোনোভাবে নিজের বিশ্ব থেকে অন্য বিশ্বে পা  রাখে, পরাবিশ্বের চৌকিদার হানা দেয় তার কাছে, তাদের উদ্দেশ্য থাকে, তাকে কোন ভাবে পরাবিশ্বে নিয়ে আসার।"
পলা বাধা দেয় নন্দিনীকে, "নন্দিনী, কিন্তু এই মননশক্তিতে পারদর্শী হওয়ার অর্থ কি?"
হালকা হাসে নন্দিনী; তারপর নিজের মুখের উপর হাত বুলোয়, হাত সরালে দেখা যায়, নন্দিনীর মুখটা অবিকল পলার মতো হয়ে গেছে, "মননশক্তিতে পারদর্শী হওয়ার অর্থ, সোজা ভাষায়, ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ করে ম্যাজিক করতে পারা; কোন ব্যক্তিকে অসঙ্গতি বলা হয় যদি সে তার জীবনকালে  যে জগতে জন্ম নেওয়ার কথা, সেই জগৎ ছাড়া অন্য কোন জগতে কোনভাবে এসে উপস্থিত হয়। যেকোন অসঙ্গতি, যে দুই জগতে ছিল, সেই দুই জগতের  মধ্যের যেকোনো একটিতে কোন নতুন টানেল খোলা হলে সেটা সেন্স করতে পারে, এবং সেই টানেল ব্যবহার করে অন্য যেকোন বিশ্ব থেকে সেই জগতে এসে উপস্থিত হতে পারে। সেই টানেল বন্ধ করারও ক্ষমতা আছে তাদের। কিন্তু সাধারণত, অসঙ্গতিদের নিজে থেকে কোন নতুন টানেল খোলার ক্ষমতা নেই। কথিত আছে, বহুবছর আগে কোন একজন অসীম শক্তিশালী অসঙ্গতি সেই ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। তিনিই পরাবিশ্বের সাথে প্রধান-বিশ্ব গুলির সংযোগস্থাপন করেন। কিন্তু নিজের সেই শক্তির বহু ব্যবহার করার ফলে তাঁর অকালমৃত্যু ঘটে।"

নন্দিনী আবার নিজের চেহারায় ফিরে আসে,  "আসলে শৃঙ্খলকরা নিজেরাও কোনো এক সময়ে অসঙ্গতিই ছিলেন। এখন পরাবিশ্বের মানুষ তাদের দিয়েই বিভিন্ন জগৎ থেকে অসঙ্গতিদের একত্র করে, আর তার পর তাদের প্রশিক্ষণ দেয় মননশক্তিতে, যাতে করে পরবর্তী প্রজন্মের চৌকিদার তৈরি করা যায়! আমাকে যেমন এই দশ বছর ধরে মাইন্ড প্রজেকশন-এ ট্রেইন করা হয়েছে।  এর মানে আমি চাইলে, তোমাদের যা খুশি ভাবতে বাধ্য করতে পারি, ভারী জিনিসপত্র শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে তুলে ছুড়ে দিতে পারি, আর যদি নিতান্ত প্রয়োজন পড়ে, তবে...."

-"তার মানে, নন্দিনী, তুই এতদিন ধরে আমার মা সেজে..." নাজিয়া কথাটা শেষ করতে পারে না।

নন্দিনী ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে তাকায় নাজিয়ার দিকে, "নাজিয়া, আমি খুব দুঃখিত, কিন্তু তোর মা ওই একসিডেন্টে মারা গিয়েছিলেন, দুই জগতেই; সেই সময়ে আমি পালাচ্ছি শৃঙ্খলকদের এড়িয়ে,  পরাবিশ্বের একটা অচেনা জঙ্গলে তখন আমি। হঠাৎ সেন্স করি যে একটা টানেল খোলা হয়েছে এই জগতে; আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। এই জগতে যেহেতু আমার জন্ম নেওয়ার কথা ছিল না, এখানে আমি অসঙ্গতি। আমি জানতাম, আমি যদি আবার অসঙ্গতি হয়ে উঠতে পারি, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে অন্য কোন জগতে নিয়ে যাওয়া নিয়মবহির্ভূত; এমনকি পরাবিশ্বেও ! মননশক্তি প্রয়োগ করে, আমি তখনি এখানে এসে উপস্থিত হই। ঠিক তোদের একসিডেন্টের জায়গাটায়।  একসিডেন্টটা তখন ঘটে গেছে! তোরা তিনজনেই পড়ে আছিস, তুই অজ্ঞান। শৃঙ্খলকদের সবার ক্ষমতা এক রকম নয়, আমি যদি অন্য কারোর রূপ ধারণ করি, আমাকে খুঁজে পাওয়া তাদের পক্ষে খুব সহজে সম্ভব না। আমি যখন দেখি যে দুই জগতেই, মানে আমাদের এই প্রধান-বিশ্ব এবং তার নতুন শাখা বিশ্ব, দুজায়গাতেই ফতিমাদিদি মারা গেছেন, আমি ফতিমাদিদির রূপ ধারণ করে তাঁর এই জগতের দেহ অন্য জগতটিতে পাঠিয়ে, টানেলটা বন্ধ করে দিই।"

নন্দিনীর কথাটা শেষ হওয়া মাত্র নাজিয়া উঠে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। সৌম্য ওর পিছনে যাবে বলে ওঠে, কিন্তু পলা ওকে টেনে বসায়, বলে, "ওকে একটু একা থাকতে দে!" রিজু ব্যাপারটা দেখে, সে এতক্ষন দাঁড়িয়েছিল বসারঘর থেকে মূলবাড়িতে ঢোকার দরজার খুব কাছে। কেউ লক্ষ্য করে না, সে ঘরের ভিতর ঢুকে যায়। ঠিক তখনি, দিপু প্রথমবার কথা বলে ওঠে, "কিন্তু তুই যদি টানেল বন্ধই করে দিয়েছিলি, শৃঙ্খলকরা এলেন কি ভাবে? আর তুই পালাচ্ছিলিই বা কেন শৃঙ্খলকদের এড়িয়ে?"

-"একটু আগে বললাম না, পরাবিশ্বের সাথে কয়েকটি জগৎ আলাদাভাবে  টানেল দিয়ে যুক্ত; এক অমিত শক্তিশালী অসঙ্গতি সেই ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সমস্ত টানেল ব্যবহার করার একমাত্র অধিকার আছে শৃঙ্খলকদের। অন্য কেউ সেই টানেল ব্যবহার করলে, সে সোজা গিয়ে পৌঁছয় পরাবিশ্বের কারাগারে। প্রধান জগৎ গুলি থেকে শাখা জগৎ গুলিতে যাওয়ার জন্য নতুন টানেল তৈরির অপেক্ষায় থাকতে হয়।  শৃঙ্খলকরা আমার খোঁজে এসেছে পরাবিশ্ব থেকে", একটু নিশ্বাস নেয় নন্দিনী,
-"আর আমি পালাচ্ছিলাম, তার কারণ, আমার ট্রেনিং শেষ হয়ে এসেছিল, প্রায়। কিন্তু শৃঙ্খলকদের কাজের একটা পার্ট হচ্ছে মননশক্তি প্রয়োগ করে মানুষ খুন করা! সেটাও কেন? কারণ সেই মানুষটা নিজের কৌতূহল এবং প্রতিভার জোরে একটি অসাধারণ আবিস্কার করেছে। অথবা, সেই মানুষটা তার কাছের কোনো মানুষকে একদল অচেনা সন্ন্যাসীদের হাতে তুলে দিতে রাজি হয় নি! এর সবটাই আমার মনে হত পরাবিশ্বের চালকদের চক্রান্ত, যাতে করে তাদের দখলদারি বজায়  থাকে বাকি দুনিয়া গুলোর ওপর। আমি এই কাজ করতে রাজি ছিলাম না। আমার আগেও বেশ কয়েকজন অসঙ্গতি এই কাজে অরাজি হয়ে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিল, কেউ কেউ পালাতেও, যারা ধরা পড়েছিল, তাদের শাস্তি ছিল মৃত্যু! এক শুভাকাঙ্খির সাহায্য নিয়ে আমি পালিয়ে যাই আমাদের ট্রেনিং সেন্টার থেকে; নিজের শক্তি আর বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে মাসখানেক পালিয়েও বেড়াই; ধরা পড়েই যেতাম হয়তো, যদি না এই টানেলটা খোলা হত!"

কথা শেষ করার সাথে সাথে অরুণাভর দিকে কৃতজ্ঞ চোখে তাকায় নন্দিনী। সর্বানী বোনের কাছে এসে পিঠে হাত রাখেন তার। দিদির দিকে চোখ ফেরায় নন্দিনী।
"আমি অনেক  ভেবেছি তোর কাছে এসে সব বলি, কিন্তু ভাবতাম যদি সঞ্জীবদা আমায় বিশ্বাস না করে? যদি শৃঙ্খলকদের সাথে যোগাযোগ করে আবার? যদি জানতাম রিজু সূত্রধার এই জগতের, তাহলে অবশ্য দেরি করতাম না...."
সৌম্য প্রশ্ন ছুড়ে দেয় নন্দিনীর দিকে, "আচ্ছা, সূত্রধারের ব্যাপারটা কি তবে? মানে কেউ কিভাবে সূত্রধার হয় ?"
-"ঠিক বলতে পারবো না, তবে যতটুকু শুনেছি পরাবিশ্বের সেই ট্রেনিং সেন্টারে, প্রত্যেক দুনিয়াতে কিছু মানুষ থাকেন, যাদের এম্প্যাথি বেশি থাকে, মানে সাধারণ মানুষদের থেকে অনেক বেশি সিক্সথ সেন্স থাকে এঁদের। এঁদের সাথে যদি কোন ভাবে কোন অসঙ্গতির কোনো রক্ত-সম্পর্ক থাকে, তবে এঁরা শৃঙ্খলকদের দেখতে পান।"

অরুণাভ পরের প্রশ্নটা করে, "আচ্ছা, তুমি রূপ পাল্টানো, আর টেলিকিনেসিস  ছাড়া আর কি করতে পারো বলছিলে ? যদি নিতান্ত প্রয়োজন পড়ে ?"
নন্দিনী একটু হাসে, "অনেকদিন আগে, আমাদের ট্রেনিং সেন্টার থেকে  একজন অসঙ্গতি পালাতে চেয়েছিলেন। আমি তখন খুব ছোট, আর তিনি খুব সহানুভূতি সম্পন্ন ছিলেন আমার প্রতি। উনি প্রায়  শেষমুহূর্তে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন, শৃঙ্খলকরা ওনাকে মারতে  উদ্যোগ নেয়; এবং সেটা আমাদের সবার সামনে, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ পালানোর সাহস না করে! তখনই আমি নিজের একটা বিশেষ ক্ষমতা..."
ঠিক এই সময়ে ঘরের আলোটা হঠাৎ নিভে যায়! নন্দিনী এক মুহূর্তে সজাগ হয়ে ওঠে, "দিদি, অরুণাভদা, আমার পিছনে, সবাই! ওরা আসছে!"

আলোটা জ্বললে সভয়ে দেখেন সর্বানী ঘরের মধ্যে রক্তচক্ষু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ছয়জন শৃঙ্খলক।
ওঁদের মধ্যে একজন কথা বলে ওঠেন, কিন্তু ওদের দিকে না, বসার ঘর আর ডাইনিং-এর মাঝের দরজার দিকে তাকিয়ে, সেখানে রিজু দাঁড়িয়ে আছে।
- "সূত্রধার, কথা রেখেছ তবে তুমি! আমরাও কথা রাখব। যদি অসঙ্গতি আমাদের সঙ্গে ফিরে যেতে রাজি হয়, এই জগতের কেউ মারা যাবে না; এমনকি নিয়মভঙ্গকারীও না; কিন্তু যদি সে পুনরায় নিয়ম ভাঙ্গে, তবে তার মৃত্যু অনিবার্য!"
নন্দিনী ততক্ষনে বাকি সকলকে আড়াল করে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, রিজুর দিকে তাকায় সে। রিজু   কিছুটা কৈফিয়ত, আর কিছুটা দোষ দেওয়ার গলায় বলে ওঠে, "তুই এই জগতের কেউ না, নন্দিনী, তোর জন্যে অনেকগুলো মানুষ মারা গেছে এই বাড়িতে, তুই নাজিয়াকে ঠকিয়েছিস এক মাস ধরে, তুই আমাদের কেউ না, তোর চলে যাওয়া উচিত নিজের জগতে, বা যেখান থেকে এসেছিস! আমি অন্তত তাইই মনে করি!"
সর্বানী রাগী গলায় বলে ওঠেন, "রিজু!"
নন্দিনী শৃঙ্খলকদের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলে, "দিদি, ও পুরোটা শোনেনি, আর আপাতত আমাদের সমস্যা সেটা নয়; নিয়ম অনুযায়ী, আমাকে এই জগৎ থেকে কেউ নিয়ে যেতে পারবে না যতক্ষণ না আমি নিজে চাইছি। আর শৃঙ্খলকদের নিয়ম ভাঙার শাস্তি, মৃত্যু!"
শৃঙ্খলকরা অট্টহাসি হেসে ওঠেন, ছয়জনের হাসির আওয়াজে বাড়িটা গমগম করে ওঠে।  তারপর প্রধান শৃঙ্খলক বলেন, "অসঙ্গতি! তুমি না চাইলে, তোমাকে এই জগৎ থেকে নিয়ে যেতে পারবো না, ঠিকই। কিন্তু তোমার দিদি, তার ছেলে, তোমার বন্ধুরা, এদের সকলের মৃত্যুর দায় নিয়ে এই জগতে থেকে যেতে চাও তুমি? শেষ সুযোগ এটা তোমার, ভেবে দ্যাখো"; কথা শেষ হওয়ামাত্র,
গলার  রুদ্রাক্ষের মালা জপ করার মত করে হাতে নেন ছয় সন্ন্যাসী একসাথে। তারপর চোখ বন্ধ করেন, বাইরে কড়কড় শব্দে বাজ পড়ে একটা! সবার অলক্ষ্যে কখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে কেউ খেয়ালই করেনি!
অরুনাভ হঠাৎ করে মাটিতে বসে পরে, বুকে হাত চাপা দিয়ে! সর্বানী এবং বাকি সকলে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন অসহায় ভাবে!
শুধু নন্দিনী সেদিকে ফিরেও তাকায়  না; সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শৃঙ্খলকদের দিকে। তার দুই হাত দুই পাশে ছড়ানো। অরুণাভ যখন প্রায় আর নিশ্বাস নিতে পারছে না তখন, নন্দিনী দুটো হাত গুটিয়ে এনে সামনের দিকে ঠেলে দেয়। তারপর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে  সে।

অরুণাভর বুকের ওপর থেকে পর্বতপ্রমাণ চাপটা এক মুহূর্তে সরে যায়, প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেয় সে, তার পর ভালো করে তাকিয়ে দেখে, ঘরের মধ্যে শৃঙ্খলকদের চিহ্নমাত্র নেই, সবাই মাটিতে পড়ে থাকা নন্দিনীর পাশে গিয়ে বসেছে; রিজুও। নন্দিনী বেঁচে আছে, তবে তাকে দেখলে বোঝা যায় সে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। রিজু তখন ক্ষমা চাইছে মাসির কাছে, যেচে বিপদ ডেকে আনার জন্য! চোখের সামনে অরুণাভদাকে প্রায় মরতে দেখে সে বুঝেছে নন্দিনী না, শৃঙ্খলকরাই আসলে ক্ষতিকারক!
 
নন্দিনী রিজুর মাথার চুল গুলো ঘেঁটে দেয়। বোঝা যায়, সে রিজুকে ক্ষমা করে দিয়েছে।
বেশ একটা সম্ভ্রম নিয়ে দিপু জিজ্ঞেস করে, "নন্দিনী, তুই একা ওদের ছয়জনকে..."
-"দিপু, একটা মানুষকে মেরে ফেলতে যে পরিমাণ মননশক্তি  লাগে, তার খুব কমই লাগে অন্য যেকোনো কাজ করতে; এমনকি ছয়জন শক্তিশালী শৃঙ্খলককে কোন জগৎ থেকে সরিয়ে ঠেলে পরাবিশ্বে পাঠিয়ে দিতেও ! ওরা নিজেদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে অরুণাভদাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছিল, আমার দিকে ওদের নজর ছিল না।  অবশ্য যদি জানত আমি ঠিক কি করতে পারি..."
তাকে কেটে দিয়ে পলা সভয়ে  প্রশ্ন করে,"আবার যদি ফিরে আসে ওরা ? পরাবিশ্ব তো যুক্ত, তাই না, আমাদের দুনিয়ার সাথে?"
সর্বানীর সাহায্য নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসে নন্দিনী, "আপাতত ফিরতে পারবে না।" তারপর অরুণাভর দিকে তাকিয়ে হালকা হাসে, "যদি খুব দরকার  পড়ে, অরুণাভদা, তবে আমি পরাবিশ্ব আর যেকোনো দুনিয়ার মধ্যে তৈরি টানেল বন্ধ করে দিতে পারি। সাধারণ অবস্থায় সেটা করার ক্ষমতা আমার আজও হয় নি। কিন্তু যদি কারোর মরণ-বাঁচন নির্ভর করে তখন...পরাবিশ্বের সেই ট্রেনিঙ সেন্টারে সেই  সহানুভূতিশীল বিদ্রোহী অসঙ্গতিকেও এই ভাবেই বাঁচিয়েছিলাম সেদিন; তখন শৃঙ্খলকরা বোঝেনি ঠিক কি হয়েছিল; ওরা জানত কেউ একজন আমাদের মধ্যে কাজটা করতে পারে, কিন্তু কে, সেটা তারা জানত না; তবে আজকের পরে...."

কথা বলতে বলতে নন্দিনী আনমনা হয়ে গিয়েছিল একটু। তারপরেই সেই ভাবটা কাটিয়ে উঠে হাসে সে,  "তবে পলা, ওরা যাই জেনে থাকুক,  এই মুহূর্তে কোন জীবিত অসঙ্গতিরই ক্ষমতা নেই কোন টানেল তৈরি করার। সুতরাং আপাতত কোন ভয় নেই!"
কথাটা  বলে  নন্দিনী  একহাতে সর্বাণী, আর অন্যহাতে রিজুর হাত চেপে ধরে; তারপর নিজের কথাটারই পুনরাবৃত্তি করে, "কোন ভয় নেই।"



                                                                       !!সমাপ্ত!!
                                 

সমাপনান্তে:

সৌম্য 

সৌম্য রিজুদের বাড়ির বারান্দায় এসেছিল মাকে ফোন করতে। ঘরের ভিতর থেকে সিগন্যাল পাচ্ছে না সে। নন্দিনী ফিরে আসা, শৃঙ্খলকদের বিদায় হওয়া, এসব নিয়ে সর্বানীকাকিমা এতটাই আনন্দিত যে, আজ কিছুতেই ওদের কাউকে রাতের খাবার না খেয়ে যেতে দিতে রাজি নন।
বারান্দায় এসে হকচকিয়ে যায় সে। গ্রিল গেটটা খোলা। আর গেটের বাইরে নাজিয়ার সাইকেলটা পড়ে আছে মাটিতে। কিন্তু  রিজু যে বলেছিল নাজিয়া  যখন উঠে যায়, তখন ও দেখেছিল নাজিয়া চলে গেলগিয়েছিল  সাইকেল নিয়ে? পলা তো বললো নাজিয়াকে ও ফোনও করছে !
পলাও ততক্ষনে বাইরে এসেছে, "এই সৌম্য, নাজিয়ার ফোন আউট অফ রিচ বলছে, কোথায় গেল বলত মেয়েটা?"
বলতে বলতেই পলা চুপ করে যায়; সৌম্যও দেখেছে জিনিসটা। নাজিয়ার চটিটা পড়ে আছে বারান্দায়; কিন্তু  নাজিয়া কোথাও নেই।

নাজিয়া 

সেই সময়, এই সব কিছু থেকে অনেক অনেক দূরে, একটা অন্ধকার পোড়ো বাড়ির সামনে চোখ খোলে নাজিয়া। একটু ধাতস্থ হয়ে তার মনে পড়ে, নন্দিনীর উপর প্রাথমিক রাগটা কমলে  রিজুর বাড়িতে ফিরে এসেছিল সে কৌতূহলের বশে; কিন্তু ঘরে ঢোকার মুখে কোথাও থেকে একটা অদৃশ্য শক্তি তাকে আঘাত করেছিল, আর চারপাশটা অন্ধকার হয়ে এসেছিল।
অন্ধকারটা চোখ সয়ে এসেছে নাজিয়ার। সামনের বাড়িটায় চোখ পড়ে তার; বাড়িটা দেখে মনে হচ্ছে, অন্তত কুড়ি বছর এবাড়িতে কেউ বসবাস করেনি। হঠাৎই বাড়িটা চিনতে পারে নাজিয়া; একটু আগে সে এই বাড়িটাতেই ঢুকতে যাচ্ছিল। এটা রিজুদের বাড়ি।

                                                             
                                              ***************************************