Search This Blog

Friday, June 12, 2020

রাজনীতি এবং ছাত্রছাত্রীরা

এক টালমাটাল সময়ে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। ভূস্বর্গ কাশ্মীর সত্যিই 'ভয়ঙ্কর' হয়ে উঠছে দিনদিন, বাজারে আগুন লেগেছে, বিকিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় রেল, ভারত পেট্রোলিয়াম, এমনকি ভারতীয় পরিচয়টুকুও! হাতে  ভোটার, আধার , প্যান ইত্যাদি কমপক্ষে তিন- তিনটে সরকারি 'কার্ড' থাকলেও আমরা 'ভারতীয়'  কিনা তাই নিয়ে সন্দেহ দানা বেঁধেছে দেশের শাসকের মনে।

সময়টাকে একটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাক।  আজ থেকে দশ বছর পরের কথা। পেঁয়াজের দাম ছাড়িয়ে যাবে কমপক্ষে ২০০ টাকা প্রতি কেজি। ২০০৯ সালে পেঁয়াজের দাম ছিল সবোর্চ্চ ৩০ টাকা প্রতি কেজি, যা ২০১৯-এ এসে দাঁড়িয়েছে গড়ে ৮০ টাকা প্রতি কেজি। দশ বছরে এই রোজকার রান্নার উপকরণটির দাম বেড়েছে প্রায়  ২৬৭ শতাংশ! ততদিনে কিন্তু বিক্রি হয়ে গেছে  ৯০%  ভারতীয় রেল, দূরপাল্লার ট্রেনের ভাড়া বেড়ে প্রায় বিমানভাড়ার সমান। সরকার আর ভর্তুকি দেয় না রান্নার গ্যাসেও, কারণ ভারত পেট্রোলিয়ামও  আর  নেই সরকারের হাতে। দশবছর পরে, আজকের সদ্য গোঁফ ওঠা,  আঠেরো তখন কপালে ভাঁজ ফেলা আঠাশ। হাতে তার চাকরি নেই, আর যদিও বা  আজ 
চাকরি থাকে, কালকেও যে থাকবে সেই নিরাপত্তাটুকু নেই! হয়তো মাথার উপর বাবাও  নেই সেই যুবকের, কারণ দশ বছর আগে, এই ২০১৯-২০ তে, কয়েকটা কাগজের অভাবে তার বাবাকে যেতে হয়েছিল ডিটেনশন ক্যাম্প! সেদিনের সেই যুবক, আজকে এখনো ছাত্র, যাকে বারংবার তার শুভাকাঙ্খীরা সাবধান করছেন, "কলেজে যাচ্ছো যাও, ইউনিয়ন অফিসের ধারকাছ দিয়েও যেও না!" 

দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলিতে ঝড় বয়ে গেছে শেষ কিছু দিন ধরে।  ছাত্র-ছাত্রীরা বিক্ষোভ দেখিয়েছে, গলা তুলে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানিয়েছে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির বিরুদ্ধে। "কাগজ আমরা দেখাবো না" থেকে শুরু করে শিক্ষাক্ষেত্রে ক্রমহ্রাসমান সরকারি অনুদান, বেতনবৃদ্ধি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকে পুলিশ এবং সরকারি মদতপুষ্ট গুন্ডাদের দৌরাত্ব সবই উঠে এসেছে সেখানে। আর এই ছাত্রবিক্ষোভ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বস্তুত দুইরকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। একদিকে যেমন সরকার এবং হামলাকারীদের নিন্দায় মুখর হয়েছেন একাংশের মানুষ, তেমনি ছাত্রছাত্রীদের আদৌ এইসব বিক্ষোভমূলক কর্মসূচিতে থাকা উচিত কিনা, থাকলেও কতটা সক্রিয়ভাবে, তা নিয়ে নানা আলোচনায় সরগরম পাড়ায় মোড়ের চায়ের দোকান থেকে "ঘন্টা খানেক সঙ্গে সুমন"!    

কতকগুলো ঘটনা একটু দেখে  নেওয়া যাক-
 ঘটনা-১: 

২০১৭ সালে মিনিস্ট্রি অফ হিউমান রিসোর্স এন্ড ডেভেলোপমেন্ট ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি ( IIT )এবং  ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সাইন্স এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (IISER) গুলিতে পিএইচডি করার খরচবৃদ্ধির ঘোষণা করে।  বেতন বৃদ্ধি হয় প্রায় ২৭৬%.  IIT এবং IISER গুলিতে সেইভাবে সম্মিলিত ছাত্র সংগঠন বলে সেইভ কিছু গড়ে ওঠেনি আজও। ছাত্র-ছাত্রীরা এই  বেতন-বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানায় সোশ্যাল মিডিয়ায়, কিন্তু প্রতি সেমেস্টার  শেষে তাদের এই বর্ধিত বেতনটা আজও গুনতেই হয় ।

ঘটনা-২:

 ২০১৮ সালে পিএইচডি 'র ছাত্র-ছাত্রীদের  স্কলারশিপ বাড়ানোর দাবি অগ্রাহ্য করতে ব্যর্থ সরকার নিতান্তই চক্ষুলজ্জার খাতিরে  স্কলারশিপ 'বাড়ায়' মাত্র ২৪%. সঙ্গে সঙ্গে কমিয়ে দেওয়া হয় হাউস-রেন্টাল আল্লাওয়েন্স (৩০% থেকে কমিয়ে করা হয় ২৪%) .

ঘটনা-৩:

২০১৯ এর  সেপ্টেম্বরে  মিনিস্ট্রি অফ হিউমান রিসোর্স এন্ড ডেভেলোপমেন্ট  ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (IIT ) গুলিতে  M-Tech পড়ার খরচ বৃদ্ধি করে প্রায় ৯০০ শতাংশ। দেশ জুড়ে শিক্ষা  প্রতিষ্ঠান গুলিতে আবার শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন।  দিল্লির জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় সাংগঠনিক ভাবে শুরু হয় বিরোধ। এই  ছাত্র আন্দোলনের কাছে মাথা নত করে গত ডিসেম্বরে অবশেষে বেতন-বৃদ্ধিতে স্থগিতাদেশ ঘোষণা করেছে সরকার।   

এই তিনটে ঘটনার মধ্যে পার্থক্যটা কোথায় বলুন তো? প্রথম দুটি ঘটনায় ছাত্র-ছাত্রীরা সংঘবদ্ধ ছিল না।  তিননম্বর ঘটনাতে প্রতিবাদ এসেছিলো ঐক্যের হাত ধরে।  আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ছাড়া এই ঐক্য সম্ভব নয়, বিশেষত আমাদের মতো এতো বিরাট দেশে। 

যদি বলেন যে ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের সমস্যা নিয়ে প্রতিবাদ করুক, সমস্যা নেই, কিন্তু দেশের রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে তাদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই তাদের, হাজার হলেও "ছাত্রাণাং অধ্যয়নং তপঃ", তবে মনে করুন একটু আগেই যে আঠাশের যুবকটির কথা হচ্ছিলো।  আজকের দেশের সমস্যা আজ থেকে মাত্র দশ বছর পর গিয়ে তার নিজের সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে, তাহলে তার কি অধিকার নেই আজকের সমস্যার সমাধান খুঁজতে চাওয়ার? চলুন না একটা অন্যরকম স্বপ্ন দেখি, যেটার শুরু আজকের সদ্য তরুণ  ছাত্র-ছাত্রীদের দেশ, কাল এবং তার নানারকম সমস্যা নিয়ে একটু ওয়াকিবহাল হওয়া দিয়ে।  একটুখানি পড়ার বইয়ের বাইরের পড়াশোনা করা দিয়ে। একটুখানি মত-প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়ে।  দশ বছর পরে দেখবেন, হাসপাতালে ঢুকে সরকারি মদতপুষ্ট গুন্ডারা আর তরুণ ডাক্তারকে মেরে অন্ধ করে দিচ্ছে না, পাড়ার ক্লাস ফাইভ ফেল 'দাদা' স্কুলে ঢুকে M.Sc. করে আসা মাস্টারমশাইকে শাসাচ্ছে না। দেশটা হয়তো টিঁকে যাবে তাহলে এতকিছুর পরেও!

আর যদি মনে হয়  রাজনীতিতে জড়িয়ে গেলেই কেরিয়ারের সাড়ে-সর্বনাশ হয়ে গেলো, তাহলে একটিবার অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মনে করে নেবেন।  বাঙালির ছেলে, JNU তে পড়াকালীন রাজনৈতিক ছাত্রআন্দোলনে যুক্ত ছিলেন।  ১০ দিন জেল খেটেছেন আশির দশকে। গতবছর একটা নোবেল পেয়েছেন অর্থনীতিতে! উনি যদি ছাত্রাবস্থায় সক্রিয় রাজনীতি করেও একটা নোবেল পেতে পারেন, আমরা একটুখানি সময় দেশের জন্য ব্যয় করিই না! ১০ বছর পরে বাচ্চার দুধ-ভাত টুকু ঠিকই জোগাড় করে নেবো।