Search This Blog

Saturday, January 13, 2018

knocking on heaven's door

আকাশের গায়ে মেঘ ছিল কি? বোধহয় ছিল।  ঠিক মাথার উপরে, অনেক উপরে, যেখানে পৌঁছনোর অনেক আগেই মানব-'সভ্যতা' ধ্বংস হয়ে যেতে বাধ্য, একটা তারা টিম টিম করে জ্বলছিল।  একটা বৃত্ত, বৃত্তের নিচের হেমিস্ফিয়ারে বসে আছি, নাকি ছিলাম? ঠিক মনে পড়ছে না।  মনে পড়ছে পাশে একটা সাদা খুঁটি ছিল , একটু আগে ওটায় ঠেস  দিয়ে বসেছিলাম।

 নীল, এই মাঠটায় তোরা ক্রিকেট খেলতিস।  আর আমি ওই দূরে অশ্বত্থ গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে ডিলান শুনতাম- knock, knock, knocking on heaven's door! যাঃ এই স্বভাব হয়েছে এখন, বড়ো পিছন পানে ফিরে যাই। কথা হচ্ছিলো তারা নিয়ে। প্রেমে পড়লে সক্কলে তারা গোনে, আমরাও গুনেছি! কিন্তু ওই একটা তারা, গোটা আকাশে ওই একটা তারা ওর মধ্যে একটা টান আছে। আজ আমার মতোই ও-ও  সাহস করে একলা এই অন্ধকারে এসে বসেছে, ওর নাম ঋত্বিক দি? অন্ধকারের পূজারী? ব্যর্থতার? melancholy'র?

দূরে রাস্তা দেখা যাচ্ছে একখানা, গাছের বাহারি করা, দুদিকে গাছ লাগানো আর কি! আর মাঝে মাঝে ল্যাম্পপোস্ট।  রাস্তাটার উপর সাদা আর হলুদ আলো কাটাকুটি খেলছে, আর অন্ধকারটা বেশ জমাটি মেজাজে করছে আম্পায়ারিং!  এটা গেছে সোজা সেই সরু কাঠের ব্রিজটা পর্যন্ত, যেটার দুদিকে আমরা দুজন দাঁড়িয়ে ছিলাম শেষ দিন, আর সেটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছিল। শব্দটা এখনো শুনতে পাচ্ছি, নীল, বিশ্বাস কর।  কাঠের ভেঙে যাওয়ার শব্দ, কাঠের উপর আঘাতের শব্দ। কাঠের উপর করাঘাতের শব্দ!

মাঠটা একটা বৃত্ত। বৃত্তের নিচের হেমিস্ফিয়ারে আমি বসে আছি। একটাই তারা জ্বলছে আকাশে। গোল করে বৃত্তের পরিধি ধরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে সাদা মৃত্যুর মতো কুয়াশা -এক্ষুনি গিলে ফেললো বলে! দরজায় কেউ প্রবল আঘাত করছে নীল, আমার কান ফেটে যাচ্ছে----
knock knock knocking on heaven's door....
knock knock knocking on heaven's door!!

Thursday, January 11, 2018

ঝুমকোলতা

ঝুমকোলতা দেখেছো??

আমি দেখেছি। আমার বাড়ির গলির ঢোকার ঠিক মুখে একটা ভাঙা পাঁচিলের উপর ঝুলে থাকতো। পাঁচিলের ওপারে ছিল একটা পুরোনো বাড়ি, একদল বাদুড় থাকতো সেখানে। রোজ সন্ধ্যেবেলা পড়ে ফেরার সময়, এক পা দু পা, তার পর একদৌড়ে বাড়ি। বিশ্বাস করো, ঝুমকোলতাটাকে খিলখিলিয়ে হাসতে শুনতাম পিছনে।

Image result for ঝুমকোলতা
বাড়িটা তোমার আমার বাড়ির মতোই, শুনেছি ওখানে এক ঠাম্মা থাকতেন, ছেলেরা সব বাইরে থাকতো, সে সব যখনকার কথা আমি তখন শীতের সকালে রোদ্দুরে শুয়ে শুয়ে নাকি হাত পা ছুঁড়ে বিল্লুর সাথে খেলতাম। বিল্লুর ছবি দেখেছি, অ্যালবাম-এ, ইয়া মোটু একটা বেড়াল। আমার বিল্লুকেও মনে নেই, ঠাম্মাকেও না। আমার মনে যতদূর পড়ছে, বাড়িটা অন্ধকার বুকে নিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আছে।  ভাঙা পাঁচিলের ফাঁক  দিয়ে ঘাস-পাতা জন্মানো বাগান, আর ওই ঝুমকোলতা।
রনি, বিট্টুরা ঘুড়ি ওড়ানোর কালে, ভো -কাট্টা ঘুড়ি ধাওয়া করতো যখন, তখনও ওই বাগানে যেত না, ওটা ছিল আমাদের নিজস্ব 'forbidden forest'..কিন্তু ঝুমকো, বরাবর আমাকে বড্ড টানতো। ঠাম্মার ছেলেরা কক্ষনো আসেনি বাড়িটায়।

একটু কিশোরীবেলায়, যখন 'দাশু' থেকে 'দত্তা'য় উত্তরণ হয়েছে, হঠাৎ স্কুল ছুটির দুপুরে ঘরে  ফেরার সময় গলির মুখে দাঁড়িয়ে যেতাম একটু। ঝুমকো'র পাপড়ি গুলোয় আঙ্গুল দিয়ে একবার আদর করে দিতাম। ঝুমকো খুশি হয়ে খিলখিলিয়ে উঠতো।

কলেজকালে, ট্রেন ধরার তাড়ায় আর গল্প হতো না ঝুমকোর সাথে, তবু কোয়ান্টাম মেকানিক্স  আর সদ্য  প্রেমে পড়া ব্যস্ততার মাঝে ঝুমকোর সাথে যখন দেখা হতো, একটু যেন দুলে উঠতো পাতাগুলো; মেয়েবেলার আরেক সই আমার!
 
বাড়িটা ওরা আর রাখছে না।  কলকাতা থেকে আধঘন্টা দূরের মফস্বলে জমির দাম খুব বেড়েছে, ওখানে ফ্ল্যাট উঠবে।

আচ্ছা, ফ্ল্যাটবাড়িতে ঝুমকোলতা হয় ?

Friday, January 5, 2018

উত্তরণ

ওর একটাই সমস্যা। শব্দ গুলো কেবল পালিয়ে যাচ্ছে। আকাশ যেমন, আ গিয়ে লুকোচ্ছে টেবিলের নিচে, ক আর আ-কার নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়েছে, কি নিয়ে কে জানে! শ গম্ভীর মুখে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।  যেন ভাবছে, কি করবে, লাফ মারবে, নাকি ডানা মেলে উড়ে যাবে!
কিন্তু জানলা কোথায় এখানে? আর টেবিলই বা কোথায়! সামনের উঁচু পাথরটার দিকে তাকিয়ে আছে ও।  একটাই পাথর, প্রায় দোতলা বাড়ি সমান উঁচু। ওটায় উঠতে হবে. ওর গায়ে ছোট ছোট খাঁজ আছে, কোথাও বা আছে সামান্য একটু বাইরে বেরিয়ে থাকা পাথর।  সেখানে পা রেখে, কখনো সেগুলোকে আঁকড়ে ধরে উঠে যাও!
আর একদম উঠে যাওয়ার পর ?
গম্ভীর মুখের শ জানলা থেকে ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো, ঠোঁটের কোনে বিচ্ছু হাসি।
শব্দগুলো ওইরকমই।  কখন যে আসে কখন যে যায়! তখনি আসে যখন রক্তপাত হয়! চোখের জলের দামে আসে,  নিশ্বাস নিতে না পারার দামে আসে।
কোমরের কাছে দড়ির গিঁটটা টের পেলো ও।  পাথরটার খুব কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।
প্রথম ধাপটা কষ্টসাধ্য; ওর পক্ষে তো বটেই।
ছোটবেলায় সিঁড়িভাঙার অংক কক্ষনো মেলাতে পারেনি।  ওর গাছ থেকে আমপাড়ার গল্প 'পথের পাঁচালি' থেকে চুরি করা। পাঁচিল টপকানো দূরে থাকে, চৌকাঠ টপকে যে নিশ্চিন্দিপুর, সেখানে যাওয়াও ওর মানা ছিল। তাই প্রথম ধাপটাই এভারেস্ট। ওপরে আকাশের দিকে তাকালো ও, বুকের মধ্যে ভয়ের চোরাগোপ্তা আনাগোনা।
আকাশে বাংলা বর্ণমালা মেঘের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে, বলছে,  , ছুঁয়ে নাও আমাদের----দড়িটা টানটান।  এবার শুধু উঠে যাওয়া বাকি।
প্রথম চেষ্টা। তিরিশ সেকেন্ডও লাগলো না মাটিতে ফিরে আসতে। শব্দের থেকে বেশি তবে জীবন ? এমনটা ভাবেনি ও! শ টাও কেমন একটা হতাশ মুখে তাকালো ওর দিকে। তারপর লাফ দিলো ঘরবিহীন জানলাটা থেকে! হারিয়ে গেলো তারপর।
ভয়ের দামে শব্দ কেনার সাধ্য নেই তবে ওর ?  কিছুক্ষন উপর দিকে তাকিয়ে রইলো ও।  নীল আকাশের বদলে এক বিরাট শূন্য সেখানে। আর সেই শূন্যে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা বর্ণমালা।
আর ফিরবে না? উঁচু পাথরটার উপর থেকে একটা চেষ্টা করলে কি ধরা যায় না ওদের?
কিন্তু ভয় আর ব্যর্থতার ভয় একসাথে একটা অদ্ভুত অবসন্নতা এনে দিলো ওর মধ্যে। সব শব্দই যেন ভেঙে চূরে হারিয়ে যাচ্ছে এবার। অক্ষরহীন একটা অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকলো ও। বদ্ধ একটা ঘর, জানলা নেই , আকাশ নেই, টেবিলও নেই বোধহয়। বর্ণমালা যাওয়ার কালে রং কেও টেনে নিয়ে গেছে!

হঠাৎ একটা হাত এগিয়ে এলো, "চল তোকে উঠতে হবে"!

পাথরটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে,  সব কটা খাঁজ বুকে নিয়ে। দড়িটাও ঝুলে আছে,  উপরে একজন বসে আছে দড়িটা কোমরে জড়িয়ে , পড়ে গেলে যাতে বাঁচিয়ে নেওয়া যায়। আগে যেটা চোখে পড়ে নি ওর, সেটা হলো চারপাশে অন্য অনেকেই আছে, যারা ওই খাঁজ ধরে উঠে গেছে উপরে, কেউ অবলীলায়,  কেউ একটু কষ্ট করে।
শুধু বর্ণমালাটাই যা নেই।
আকাশ আছে, গাছ-গাছালি, পায়ে চলা পথও, কিন্তু কথা বলছে শুধু মানুষ!
পাথরের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো ও।  প্রথম ধাপটা এখন অংক. m , g , h কে ব্যালান্স করছে ফ্রিকশনের প্রতিক্রিয়া বল। প্রথম ধাপটা এখন শক্ত, কিন্তু এভারেস্ট নয়। 
প্রথম ধাপটা উঠে গেলো ও, সাহায্য নিয়েই। ভয়কে আর ভয় লাগছে না! লড়াইটা আর বর্ণমালা ফিরিয়ে আনার নয়, একটা উঁচু পাথর চড়বার। লড়াইটা আর একা একা ছায়াযুদ্ধ নয়, সহায় রয়েছে অনেকেই। লড়াইটা আর লড়াই-ই নয়. একটা সাধারণ চেষ্টা।
পরের ধাপ, আরো একটা ধাপ।  তিননম্বরে গিয়ে বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা। ভয় ফিরে  এলো বুঝি!
নিচে থেকে একটা চিৎকার-বিরক্তির নাকি উৎসাহের ও জানে না, শুধু একটা নাম কানে বাজলো, নামটা ওর। খাঁজে পা রেখে একটা ধাপ উঠলো ও।  আর একটা। তার পর আর ও একটা।
তারপর সামনে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ, অনেক নিচে ছোট্ট একটা নদী, আর কাছেই অন্য একটা পাথর ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। হ্যাঁ, হাসছে। পাথরটার ক্ষয় হয়েছে এমনভাবে, দুটো চোখের গোল আর একটা কান অবধি টানা হাসি পরিষ্কার বোঝা যায়, ঠিক যেন অভিনন্দন জানাচ্ছে উঠতে পেরে যাওয়ার জন্য।

মুখে এসে লাগছে মিষ্টি শীতের ঠান্ডা হাওয়া। হঠাৎ দেখলাম, হাওয়ার সাথে আমার দিকে ভেসে আসছে বাংলা বর্ণমালার অক্ষরগুলো, শব্দ হয়ে, বাক্য হয়ে, কবিতা হয়ে....

Tuesday, October 24, 2017

একটি 'অ'সাধারণ মৃত্যু


একটি 'অ'সাধারণ মৃত্যু 
                                                     ১
                                    গোগোল "বোধহয়" মারা গেছে!

-"কে মারা গেছে বললি ? গোগোল ? "
স্মৃতি পড়ছিলো, সামনের রবিবার ব্যাংকের চাকরির পরীক্ষা আছে, আজ শুক্রবার। জেনেরালি পড়ার সময় ও ফোন ধরে না । তিস্তা হলো হবু ডাক্তার, সে যখন ফোন করেছে অকারণে করবে না এই ভেবেই ফোনটা উঠিয়েছিলো ও।  কিন্তু গোগোল মারা গেছে এইটা এক্কেবারে কল্পনার বাইরে।
গোগোল, স্মৃতি আর তিস্তা স্কুলের বন্ধু। গোগোল পিএইচডি করছিলো কোথা থেকে একটা যেন, ফিজিক্সে। আগের শুক্রবারই ওদের দেখা হয়েছিল, তিনজনে মিট করেছিল কলকাতায়! তখন তো গোগোল একদম ঠিক ছিল! আগের মতো হাসি-ঠাট্টা, খাওয়া-দাওয়া, শপিং! এই ক'দিনে কি হলো ছেলেটার ?
তিস্তা তখনো কথা  বলে যাচ্ছে-
-"মারা গেছে বলিনি, বলেছি বোধহয় মারা গেছে ! আমি আজ বাড়ি ফিরছি। ফিরে তোর বাড়িতে যাবো। আরও কেস আছে।  একটা মেয়ে ফোন করেছিল, আমাদের দুজনের সাথে দেখা করতে চায়। তাকেও নিয়েই আসবো!"
স্মৃতি কিছু বুঝতে পারছে না , গোগোল মারা গেছে আর তিস্তা এসব কি মেয়ে দেখা করতে আসবে বলছে!"কিন্তু গোগোল মারা গেছে কিভাবে ? আর তুই জানলি কি করে ? কে মেয়ে , কোথাকার মেয়ে? আমাদের তো কাকিমার সাথে দেখা করতে যাওয়া উচিত!"
-"স্মৃতি, কুল ডাউন! গোগোল 'বোধহয়' মারা গেছে এটা আমায় উমা, মানে ওই মেয়েটাই বলেছে, ও নিজেও ঠিক জানে না! কাউকে বলতেও বারণ করছে! আর 'বোধহয় ' এর উপর বেস করে কাকিমার সাথে দেখা করে কি করবি ? আমি আসছি তোর ওখানে রাতে ! মেয়েটাও বললো ওর কোন্নগরে বাড়ি ; কলকাতার থেকে শ্রীরামপুরেই  সুবিধা। "

বোধহয় শব্দটা এতক্ষনে স্মৃতির মাথায় ঢুকলো। "কে বে মেয়েটা? কিছু কি বলেছে? গোগোলকে ফোন করেছিস?"
-" সে আর করিনি! লাগছে না ফোন। ফেসবুক-টেসবুকে ও রবিবারের পর আর কিছু দেখাচ্ছে না! আর মেয়েটা? সে  যা বলছে, তাতে আমার মেয়েটাকে সুবিধার ঠেকছে না রে, কেসটা গড়বড় লাগছে!"
-"কি বলছে?"
-"ও নাকি গোগোলের গার্লফ্রেন্ড !"
-"সে কি করে হয়? গোগোল তো...."
-"এক্সাক্টলি! গোগোল তো গে! অথচ....আচ্ছা আমি তো আসছিই  তোর বাড়ি বিকেল দিকে! দেখা যাবে!"


                                                             ***

                                                     ২
                                                  বান্ধবী !!

তিস্তা উমাকে নিয়েই এসেছিলো স্মৃতির কাছে। উমা এসেছে গোগোলের ইনস্টিটিউট থেকেই। সকালে তিস্তার ফোন পেয়ে স্মৃতির আর পড়াশোনা কিচ্ছু হয় নি। বাড়িতে চুপচাপ নিজের ঘরে একটা গল্পের বইতে মাথা গুঁজে পড়েছিল, কারোর সাথে কথাও বলে নি তেমন, মা খেতে ডেকেছেন, চুপচাপ খেয়ে এসেছে। মা'র  'এত অন্যমনস্ক কেন?' কাটিয়েছে মাথা ধরেছে বলে।
বিকেলে তিস্তা আর উমা আসতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ও! তিস্তার বাস্তব জ্ঞান বরাবরই বেশি; সে মাকে "কাকিমা শপিংএ যাচ্ছি" বলে ম্যানেজ দিয়ে  উমা আর স্মৃতিকে নিয়ে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে।

প্রথমে সবাই চুপচাপ, ঘাড় নিচু করে ফুটপাথ দিয়ে হাটছে। ভাইফোঁটা মিটে  যাওয়ার পর আর মার্কেটে ভিড় নেই তেমন; সদ্য কলেজ খুলেছে লম্বা ছুটির পর, ছাত্র-ছাত্রীদের কলকাকলিতে হিমেল সন্ধ্যে নামছে পুরোনো মফস্বলের বুকে। এরা দুই বন্ধু অপেক্ষা করে আছে উমার জন্যে। কিন্তু হয়তো অপরিচিতের সংকোচের জন্যেই সে একদম চুপ!

খানিকক্ষন এলোমেলো হাঁটার পর তিস্তা মুখ খুললো,"উমা, তুই কি কোথাও বসতে চাস?"
উমা ঘাড় নাড়ালো, নেতিবাচক!"এই ভালো! আসলে ব্যাপারটা হলো গিয়ে কোথা থেকে শুরু করবো কিছু বুঝতে পারছি না!"
-"আমার একটা আইডিয়া আছে; শোন, গোগোল আমাদের বাচ্চাবেলার বন্ধু, বুঝলি তো!" নরম গলায় শুরু করলো তিস্তা-" একদম কেজি ক্লাস থেকে ১২ ক্লাস। তার পরেও, এই দুটো হনুমান একসাথে কলেজে পড়েছে, আমি একবছর বসে তার পর ডাক্তারি পড়তে কলকাতা কাট মেরেছি! তুই গোগোলকে কবে থেকে চিনিস?"

 ওরা ততক্ষনে হাটতে হাটতে বাসন্তী কেবিনের সামনে, দুধ-চা আর ব্রেস্ট-কাটলেট খেতে কত্ত এসেছে এখানে ওরা  তিনজনে স্কুলের শেষের দিকে; কলেজেও , স্মৃতি ভাবছিলো , তিস্তা চলে যাওয়ার পর ওরা দুজন এখানে আসতো প্রায় রোজই ! এসে আলোচনা করতো টি এম এর  ইলেক্ট্রোডিনামিক্স, শ্রীজিতের সিনেমা, কলেজের কোন সিনিয়র লাইন মারার যোগ্য, এখানেই ওই কোনের দিকে সাদা পাথরের টেবিলে বসে গোগোল স্বীকার করেছিল ওর ছেলেদের দেখতে  ভালো লাগে!

ভাবনার অতল থেকে ভেসে উঠতে উঠতে স্মৃতি শুনতে পেলো উমা বলছে, "আমরা এক ল্যাবে কাজ করি না ঠিকই, কিন্তু এই এক-বছরে আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছিলাম! ইন-ফ্যাক্ট, গোগোলের আর তেমন কোনো বন্ধু নেইও ওখানে!"

স্মৃতি হঠাৎ ওকে থামিয়ে দিয়েই জিজ্ঞেস  করে উঠলো,"উমা, তোমার কেন মনে হলো যে গোগোল মারা গেছে?"

উমা ওর দিকে তাকালো, "গোগোলের একটা প্রজেক্টে রেজাল্ট এসেছিলো রিসেন্টলি। তার পর ও ঠিক করে যে বেড়াতে যাবে, তাও আবার একলা, কেরালায়! ল্যাবে ও যে কম্পিউটারে কাজ করে তার পাস-ওয়ার্ড আমি জানতাম। ও বেরোয় গত মঙ্গলবার। বুধবার আমায় টেক্সট মেসেজে জানায় যে যদি ও বৃহস্পতিবার একবারও অনলাইন না আসে, তাহলে যেন ওই কম্পিউটার খুলে আমি ডেস্ক-টপে একটা ফাইল সেভ করে রেখেছে ও, সেইটা দেখি!
"আমি কাল রাতে ওর ল্যাবে গিয়ে ওর কথা মতো ফাইলটা খুলেছিলাম, তাতে শুধু  তোমাদের দুজনের নাম আর ফোননাম্বার দিয়ে একটা চিঠি সেভ করা ছিল ....দাঁড়াও দেখাচ্ছি...."

উমা ফোন খুলে  করে চিঠিটা বার করে তিস্তার দিকে এগিয়ে দিচ্ছিলো, হঠাৎ স্মৃতি প্রশ্ন করলো সরাসরি ওর দিকে তাকিয়ে-

- "আচ্ছা, তুমি তো তিস্তাকে বলেছো যে তুমি গোগোলের গার্লফ্রেন্ড; তুমি কি জানো যে গোগোল হোমোসেক্স্যুয়াল? "



                                                             ***

                                                              ৩
                                                            চিঠি!



উমা একটা হোঁচট খেলো মসৃন পিচঢালা রাস্তায়- "ইয়ে মানে তোমরা জানো?"
 তিস্তার ঠোঁটের কোন হালকা হাসি খেলে গেলো একটা, "উমা, গোগোল আমাদের কাছে কিছুই লুকোতো না রে, আমরা সেই কবে থেকে বন্ধু, মনেই পড়ে না এখন আর!"
স্মৃতি রাস্তার দিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে, আলতো গলায় প্রশ্ন করলো, "কিন্তু ব্যাপারটা কি?"
-"আসলে গোগোলের পাশের রুমের স্যাপি, সপ্তর্ষি, একদিন ওকে দেখে ফেলেছিলো রুমের মধ্যে চোখে আইলাইনার আর ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে আয়নার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার পর থেকে ওকে সবাই রাগাত, উত্যক্ত করতো। গোগোলের ব্যাপারটা আমি জানতাম। একদিন আমি নিজে থেকেই রটিয়ে দিই যে আমি আর গোগোল কমিটেড। সবাইকে বলেছিলাম আমি গোগোলকে ওইরকম একটা ছবি তুলে পাঠাতে বলেছিলাম....গোগোল অবশ্য ব্যাপারটায় খুশি হয় নি।  কিন্তু কিছু বলেও নি। কাজ হয়েছিল এতে। ওকে নিয়ে ইয়ার্কি-ঠাট্টা গুলো কমে গিয়েছিলো..... "
স্মৃতি আর একবার মেয়েটার দিকে তাকালো,  উমা তখনো অবশ্য কথা বলে চলেছে," যাক যে, যা বলছিলাম-চিঠিটা-"
                      উমি ,
                       যেখানে যাচ্ছি হয়তো ফিরবো না! হয়তো কেন, গোগোল কিছুতেই আর ফিরবে না। তুই তো অনেকটাই  জানিস। ভালো থাকিস। যে ফোন নাম্বার গুলো লেখা আছে, ওগুলোর একটাতে অন্তত ফোন করে জানাস আমার এই চিঠিটার ব্যাপারে। মাকে যা বলার যদি আমি না বলতে পারি, তো তিস্তা  ঠিকই  বলতে পারবে। তবে ওকে বলিস স্মৃতির উপর ভরসা করতে, তাড়াতাড়ি যেন না করে, ও বললে তবেই যেন বাড়িতে জানায় ! আর স্মৃতিকে বলিস, এটা ওর ফার্স্ট এসাইনমেন্ট! ভয় না পেয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে একটু। হপ্তাখানেকের মধ্যে বাড়িতে জানালেই হবে।  তার আগে কিছু বলার দরকার নেই।
                     তোকে, তোদের তিনজনকেই সবটা বলে যেতে আপত্তি ছিল না।  তবে ব্যাপারটা আমার নিজের ডিসিশন, তোদের জড়াতে চাই নি।  সাহস ও তো লাগে একটু, নাকি! আর স্মৃতির বুদ্ধিতে মরচে পড়েছে কিনা সেইটাও দেখার ইচ্ছে ছিল!
                   -গোগোল !
                       
তিস্তা চিঠিটা জোরেই পড়ছিলো,  শেষ  হতে উমা বলে উঠলো, "কেমন একটা সুইসাইড নোট-সুইসাইড নোট মার্কা নয় কি চিঠিটা?"

তিস্তার কপালে ভ্রু জোড়া লেগে সেকেন্ড ব্র্যাকেট তৈরি করেছে," হুম! স্মৃতি, কিসব লিখে গেছে বলতো ছেলে ? এবার বাড়িতে জানাতে বারণ করেছে! তাছাড়াও যদি সত্যিই সুইসাইড করে, পুলিশ কেস টেস হয়, তাহলে তো আমরা ফেঁসে যাবো! আর তাছাড়া  ধরে ওর সাথে কন্টাক্ট না হলে তো বাড়ির লোকেও চিন্তা করবে ওর? কাকু-কাকিমা?"

স্মৃতি তিস্তার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় বললো, "দুটো পসিবিলিটি; এক, গোগোল পুরো পাগল হয়ে গেছিলো। দুই, গোগোল সুইসাইডটা করেনি!"
তার পরেই একদম এবাউট টার্ন মারলো ও,"চ তো একবার কাকিমার কাছে!"


                                                              ***


                                                                 ৪    
                                                       ছেলেদের মতো!!

গোগোলদের বাড়িতে এলে কাকিমা কখনো না খাইয়ে ছাড়েন না।  তার ওপর উমা প্রথমবার এসেছে!
"গোগোল ছাড়া বড্ড  একা লাগে! স্মৃতিটা মাঝে সাঝে আসে তাও! তিস্তা,  ছুটি-ছাটায় আসতে  পারিস একটু আধটু!" প্লেট  ভর্তি ঘুগনি এগিয়ে দিলেন সাধনা উমার দিকে..."তোমার তো খুব নাম শুনি ছেলের কাছে! আমার গোগোলটা ঐরকমই জানো  তো! এখানে যতদিন ছিল, এই দুটোর সাথে যত  মেলামেশা; তার পর ওখানে গিয়েও সেই তোমার সাথে! আসলে ছেলের আমার মন খুব নরম।  সেই জন্যেই বোধহয় মেয়েদের এত ভালো বনত ওর।" ম্লান হাসলেন সাধনা!
 তিস্তা বলছিলো "আমরাও তো শুনেছি ওর নাম খুব , আজ ওর সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো রাস্তায় , আগে ছবি-টবি দেখেছি..ব্যস, চিনে ফেললাম ! স্মৃতি বলছিলো, তুমি একলা থাকো, বলো আমাদের কথা, তো আমরা দুজন তোমার কাছেই আসছিলাম।..ওকেও ধরে নিয়ে এলাম..."
ওরা ঠিক করেছিলো জানাবে না কাকিমাকে আপাতত কিছু....তিস্তার আমতা আমতা কথা গুলো শুনতে শুনতে স্মৃতির চোখ গেলো দেওয়াল আলমারিতে রাখা সঞ্চয়িতার দিকে!

-"গোগোল, হাতে অতটা কাটলো কি করে তোর?"
কলেজ ক্যান্টিন; এস বি আর টি ডির ক্লাসের ফাঁকে এক-ঘন্টার গ্যাপ। গোগোল একমনে ভোলাদার বানানো চায়ের দিকে তাকিয়ে।
-"কাকু?" স্মৃতির গলা প্রায় না শুনতে পাওয়ার মতো।
-"আমার বয়স আঠারো শ্রী! শুধু যদি একটু ইনকামের ব্যবস্থা থাকতো, থাকতাম না বাবার সাথে আর!"
গ্লাসের চায়ে একফোঁটা নোনতা জল মিশলো কি? "আমার ভালো লাগে না জিমে যেতে! বাবা বোঝে না কেন জিমে গিয়ে বডি বানালেই আমি  সলমান খান হয়ে যাবো না! জানিস আমার সঞ্চয়িতা আলমারিতে চাবি দিয়ে রেখেছে! আমি নাকি কবিতা পড়ে পড়ে এরকম হয়ে গেছি! আচ্ছা, পৃথিবীতে কি সব কবিরা মেয়েলি? নাকি আমি মেয়েলি বলে আমার বাঁচার অধিকার নেই?"


"কাকু ফেরেন নি, না কাকিমা?" ফ্ল্যাশব্যাক কাটিয়ে স্মৃতি প্রশ্ন করে।
-"নারে, এই তো ছটা বাজলো সবে। আটটার ট্রেনে ফেরে তো। সে তো গোগোল ট্রেকে যাচ্ছে শুনে খুব খুশি হয়েছে! এই বাপ্-ছেলের ঝগড়া মিটলে আমি একটু শান্তি পাই!"

তিনজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো ওরা! তার পর তিস্তাই প্রশ্নটা করলো, "কাকিমা, গোগোল ট্রেকে গেছে?"
-"তোরা জানিস না?" সাধনা অবাক!" তোদের বলেনি? আরে ও তো ফোন করেছিল বুধবার...বলে এখন ১৫ দিন ফোনের টাওয়ার পাওয়া যাবে না, ট্রেকিং এ যাচ্ছে! কোথায় একটা জানি হিমাচলের! সে শুনে আমি তো ভয়ে মরি! কিন্তু তোদের কাকু খুব খুশি! না ছেলেটা কিছু একটা করছে সাহসী কাজ! ছেলেদের মতো!"

স্মৃতি মুখে লুচির শেষ  টুকরোটা মুখে  তুলতে তুলতে থেমে গেলো..."কাকিমা, কাকু হয়তো জানেন না, প্রচুর মেয়েও , এই বাংলা থেকেই,  ট্রেকিং করে থাকে.... "
 আবহাওয়া গুমোট হওয়ার আগেই তিস্তা সামাল দিলো, "কাকিমা, আসি তবে আজ? আমি এখনো বাড়ি ঢুকিনি....উমাকেও কোন্নগর যেতে হবে.."

গোগোলদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনজনে আলাদা হওয়ার আগে তিস্তা অনেকটা স্বগতোক্তি করার মতো করে বললো ," গোগোল তাহলে হিমাচলে ট্রেকে গেছে ? কিন্তু উমা, তুই  যে বলছিলি ও কেরালা গেছে বেড়াতে?"


                                                                   ***                     
                                                                    
                                                                     ৫
                                                                    স্বপ্ন 

ঘরের ভিতর অন্ধকার। জানলার বাইরে হিমেল রাত, কিন্তু জানলাটা খোলাই রেখেছে স্মৃতি।  জানলার পাশে টেবিলের উপরে রাখা খোলা ল্যাপটপ থেকে হালকা আলো বেরোচ্ছে। পড়াশোনায় মন বসছিলো না, তাই অনেক দিন পর ফেসবুক খুলেছিল ও। অনেকগুলো মেসেজ জমেছে দেখেও গোগোলের প্রোফাইলটা আগে খুললো ও।

"ফার্স্ট আসাইনমেন্ট"....স্ক্রিনে গোগোলের মুখটা ভেসে উঠতে দেখে কথাটা মনে পড়ে গেলো ওর...হালকা একটা হাসি ফুটে উঠলো। নাঃ, গোগোলটা পাগলই রয়ে গেলো!

-"সিরিয়াসলি পি এইচডি করবি না? নেট তো আছে ভাই তোর!" গোগোলের পি-এইচডির  অফার লেটার আসার দিন, গঙ্গার ঘাট।
-"নাঃ! এম এসসি করে ফেললাম, যথেষ্ট!"
-"তো এবার?"
-"চাকরির চেষ্টা, আর কি!"
-"ইন্দোরের  যে কলেজের  কথা বলতিস কলেজে ? ডিপ্লোমা কোর্সটা ?"
স্মৃতি হেসে উঠলো-"গোগোল, ভাই, তোর কি মনে হয়, আমি যদি আজ বাড়িতে বলি আমি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন অফ প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশনে পড়তে চাই  কি ইন্দোরে ডিটেক্টিভ ট্রেনিং কোর্স করতে যেতে চাই, বাড়ি থেকে কি বলবে? ওসব ফ্যান্টাসি ১৭ তেই ভালো লাগে! একুশে এসে মনে হয় একটা চাকরি পেলে হয়!"
গঙ্গার ওপর  দিয়ে একটা  স্টিমার যাচ্ছে ।  গোগোল সেটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। তার পর বললো,  "তোকে ভেবেছিলাম তুই নিজের স্বপ্নটা ঠিক ফুলফিল করবি! লোকে হাসবে ভেবে পিছিয়ে যাবি না"

স্মৃতি কিছু একটা বলতে  যাচ্ছিলো, গোগোলকে দেখে থেমে গেলো...সে যেন এই দুনিয়ায় নেই আর! দূরে দৃষ্টি রেখে নিজের মনে বলছে, "আমি একদিন করবো....করবোই! কে কি ভাববে, কি যায় আসে...."

মেসেঞ্জার কলের টুং-টাং আওয়াজে চটকা ভাঙলো স্মৃতির! অনিকেত ফোন করছে। অনিকেত কেন ফোন করছে?? অনিকেত তিস্তার কলেজের সিনিয়র কিন্তু সেটাই ওর একমাত্র পরিচয় না , এম-এসসির সময়ে গোগোলের একটা হালকা সম্পর্ক ছিল ওর। অনিকেত ও গে।


                                                                 
                                                       ছেলেদের মতো!!

সকালে উঠে তিস্তা দেখে স্মৃতির খান পাঁচেক মিসড কল আছে তার ফোনে। সবই রাত্তিরে করা।  চিন্তা এবং ক্লান্তি মিলিয়ে আগের দিন রাতে একটু তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে গেছিলো ও।  মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙেছে সবে।
বেসিনের পশে রাখা ওয়াল পকেট থেকে টুথব্রাশ নিয়ে পেস্ট লাগাতে লাগাতে হোয়াটস্যাপ চেক করলো তিস্তা। একটা মেসেজ আছে স্মৃতির; " যা মনে হচ্ছে, গোগোল সত্যিই আর ফিরে আসবে না, বুঝলি!"
কপালের ভ্রু জুড়ে গিয়ে সেকেন্ড ব্রাকেট তৈরি করলো তিস্তার, তড়িঘড়ি মুখ ধুয়ে  নিয়ে  স্মৃতির নম্বর ডায়াল করলো ও।
সুইচড অফ!
তিস্তা পারলে তখনি বেরিয়ে যায় স্মৃতির বাড়ির দিকে, কিন্তু মা আটকে দিলেন, "লুচি বানিয়েছি, খাবে, খেয়ে যেখানে খুশি যাবে!"
নাকে-মুখে কোনোরকমে চারটে লুচি গুঁজে যখন ও বেরোলো বাড়ি থেকে, তখন প্রায় ১০টা বাজে।
স্মৃতির বাড়ি গিয়ে শুনলো সে সকাল সকাল কোথাও একটা গেছে, বাড়িতে শুধু বলে গেছে ফিরতে রাত হবে!

একটু বেলা হতে  উমাকে একবার ফোন করলো তিস্তা, এবং ফোন ধরলো স্মৃতি।
ফোন ধরেই প্রশ্নবাণ, "অনির্বানদাকে গোগোলের কথাটা  তুই বলেছিস ?"
-"হুম, কাল কলেজে দেখা হয়েছিল, জিজ্ঞেস করলো গোগোল কেমন আছে, তাই ! কিন্তু তুই কোথায় ? সকাল থেকে ফোন করছি পাচ্ছি না! ওরকম একটা মেসেজ করে রেখে দিয়েছিস! গেছিস কোথায়?"
-"কাল তোকে বহুবার ফোন করেছি ভাই! আমি উমার বাড়িতে আছি, তুই চলে আয় , গোগোল কোথায় গেছে অলমোস্ট বার করে ফেলেছি-বাই দি ওয়ে , তুই কি জানিস ওদের রিলেশনটা জমে নি কেন?"
-"হুম, ওই তো গোগোল তো চলে গেলো, আর ওদের লং ডিসটেন্স রাখার ইচ্ছে ছিল না..."
-"সেটা তো গোগোলের ভার্সন! কাল অনির্বানদা ফোন করেছিল, তুই কোন্নগর স্টেশনে আয়, তোকে বলছি সব! এভাবে হবে না!"

                                                                   ৬
                                                                 শাপমোচন !!

কোন্নগর স্টেশনের গায়ে  একটা নতুন কফিশপ হয়েছে যেটা তিস্তা আগে দেখেনি। ওরা তিনজন ওখানেই বসে আছে একঘন্টা হলো। স্মৃতির ব্ল্যাক কফি ঠান্ডা জল হয়ে গেছে, ও একটা চুমুকও না দিয়ে ক্রমাগত কথা বলেছে এতক্ষন। তিস্তার সব শুনে মনে হচ্ছে গোগোলকে ও তো চিনতোই না এতদিন! স্মৃতি যা বলছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে গোগোল আর সত্যিই ফিরবে না।কিন্তু ও বেঁচে আছে, বলা যেতে পারে এতদিন পর হয়তো সত্যিই বেঁচে উঠেছে ওদের বন্ধু!
স্মৃতির সন্দেহ যদি ঠিক হয় তাহলে এই মুহূর্তে গোগোলের সাথে কন্টাক্ট করাটাও খুবই জরুরি!
"উমা আর আমি যাচ্ছি ওদের ইনস্টিটিউট, তুই আসবি?"
কফি মাগটা ঠোঁটে ঠেকিয়ে মুখ বিকৃত করলো স্মৃতি। তার পর সরিয়ে রাখলো।
-'অবশ্যই যাবো। আমি বাবাকে অলরেডি টেক্সট করে দিয়েছি। কিন্তু তুই সিওর যে তুই বার করতে পারবি গোগোল কোথায় যাচ্ছে?"
-"গোগোলের ব্যাপারে কথা বলছি তিস্তা! ওর কোন ব্যাপারটা আমরা জানি না বলতো?"
-"জানি না শ্রী! অনির্বানদা যেটা বলেছে তোকে সেই কথাটাই জানতাম   না!"
স্মৃতি তিস্তাকে দেখলো একবার। "হুম! কিন্তু ও যা বলে না, সেটা প্রেডিক্ট করতে সবথেকে ভালো আমরাই পারবো! উমা, তুই শুধু ওর ওই ওয়ার্ক প্লেসের কম্পিউটারটা আমায় খুলে দিস!"



এক সপ্তাহ না, একদিন! এটাই ভাবছিলো উমা।  স্মৃতি ফোনে একটা নম্বর ডায়াল করছে, ওপারে যদি গোগোল ধরে ফোনটা তবে এইটুকুই টাইম লেগেছে গোগোলের বন্ধুর ওকে খুঁজে পেতে!
অনির্বান  বলেছিলো স্মৃতিকে, "গোগোল আমাকে বলেছিলো  এই শরীর আমার ভালো লাগে না অনি, একদিন এটা ছেড়ে চলে যাবো। তখনি যদি স্টেপ নেওয়া যেত কিছুকাউন্সেলিংয়ের, তাহলে হয়তো সুইসাইড করতো না ছেলেটা!"
ব্রেক-আপ করেছিল গোগোল এই কথাটাই লিখে, আর যোগাযোগ রাখেনি।  স্মৃতি গত রাত্তিরে ইন্টারনেট ঘেটে কেরালা সম্পর্কে একখানা তথ্য আবিষ্কার করেছে। কেরল গভর্নমেন্ট  হসপিটালে অত্যন্ত কম খরচে সেক্স রি-আসাইনমেন্ট সার্জারির ব্যবস্থা করেছে! ওর ধারণা ছিল গোগোল ওখানেই গেছে, ছেলের খোলস ছেড়ে সম্পূর্ণ মেয়ে হয়ে উঠতে!
স্মৃতি  গোগোলের কম্পিউটারে লগ-ইন করে ব্রাউজার হিস্ট্রি চেক করছিলো ওদের ইনস্টিটিউট-এ এসে। সত্যিই গত কয়েক মাস ধরে গোগোল কেরালার বিভিন্ন হাসপাতালের সাইট চেক করেছে, দেখেছে ছেলের শরীর থেকে মেয়ে হতে কি করতে হয়, কেমন খরচ হয়!
সব থেকে বেশি বার যে হসপিটালের সাইট খোলা হয়েছে, সেই হসপিটালের রিসেপশনে ফোন করছে এখন স্মৃতি, রিং হচ্ছে শুনতে পেলো উমা!

                                                                   ****
কেবিনের দরজায় একটা টোকা শুনলো সঞ্চয়িতা। হাসি মুখের নার্স এসে দাঁড়িয়েছে, হাতে কর্ডলেস ফোন। "ম্যাম, ইওর ফ্রেন্ড ফ্রম বেঙ্গল, স্মৃতি!"
হাসি ফিরিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো ও, ফোনের দিকে।

Tuesday, September 5, 2017

উল্লাস

অপচয়ের  উল্লাস শেষে ক্লান্ত ? মন রে,
তুই ভুল বুঝিস না আমায়-
আমার সময়ের বড়  দাম, আলস্যের ফল উপাচারে
যায়, ভোগের উপাচার বিচার করে শ্রমের মূল্য;
রঙিন জলে অবসাদ, মেটে? বিষাক্ত ধোঁয়ায় -
পড়ে  থাকা পাতাবন্দী 'দিনবদলের স্বপ্নের' উপর
ছাই জমে, কাট-গ্লাসের ছাইদানে।

আগুন ধরানোর নৈমিত্তিক খেলায় কাগজের
পাতায় অন্যমনস্কে পোড়ে আসিড-পোড়া
কিশোরীর ঘষে দেওয়া মুখ-
আরও একবার; বাটি হাতে দিদিমাকে
দুটাকার সাথে জ্ঞান ছুঁড়ে দিই,
"কাজ করে খাও না কেন?" ট্রেনের তাড়ায়
বৃষ্টিগুলো শুধু চাষের কাজেই মাটি হয় আজকাল!

কে পাত্তা দেয়, কোথাকার কোন  কিশোর বইয়ের
চাপে কফিন-বন্দি হয়ে শুলো শেষ বিছানায়?
আমাদের জন্য যথেষ্ট  নয় কি সপ্তাহান্তের 'উল্লাস'?

বেলাশেষের হিসেব খাতায় গরমিল পেলে নাকি?
চিত্রগুপ্ত?? তুমিও, ভুল বুঝো না আমায়-
সোমরসের পাস্ টা দিয়ে রেখো, দু-দশটা
মোহর নাহয় গুঁজেই দেব, হাতের তেলোয়!















প্রকাশনার জন্য বিবেচ্য    

Tuesday, May 9, 2017

চ্যাপলিন!!

ঢোলা প্যান্ট, ছোট্ট গোঁফ আর ঘননীল ওই সরস চোখে,
চার্লি তুমি হাসছো কেন?
দেওয়াল থেকে? আমায় দেখে?

ভবঘুরে হেলাফেলায় হাসির দমক এক নিমেষে,
পাল্টে গেছে শুকনো তেঁতোয়,  ঠোঁটের পাশে,জিভের কোষে!

সিনেমাই তো! জীবন তো নয়! তাহলে আর চিন্তা কোথায়!
জীবনযাপন সহজ বলো? আমার তো নয়, তোমার কথায়!

বৃষ্টিভেজা নোনতা গালের সাক্ষী থাকুক রাতপ্রহরায়,
দুঃখ-জীবন সহজ করে, কান্না চেপে হাসতে পারায়!

জীবনই তো? ছবি তো নয়? তাহলে আর চিন্তা কোথায়?
হাসতে পারা সোজাই বলো? আমার তো না,তোমার কথায়!

ছোট্ট টুপি, লম্বা জুতো, ঘননীল ওই ব্যাকুল চোখে,
চার্লি, তুমি কাঁদছো কেন?
আয়না থেকে? আমায় দেখে?!